মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ : ধানের তুষ দিয়েই ফুটছে হাঁসের বাচ্চা। বিকল্প এই পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফুটাতে পেরে আনন্দিত বানিয়াচং উপজেলার ভাটিপাড়ার ১৫০টি পরিবার। পেশা হিসাবে হাঁসের বাচ্চা ফুটানোকেই বেছে নিয়েছেন তারা। সম্প্রতি ধানের তুষ দিয়ে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর এই পদ্ধতি দেখে অভিভূত হলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেনারি ক্লাসের ৭ শিক্ষার্থী।
গত দুই মাস ধরে হবিগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগে ইন্টার্নি করেছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ৭ শিক্ষার্থী। এরই অংশ হিসেবে তারা মাঠে গিয়ে হাঁস পালনের উপর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে ইচ্ছাপোষণ করেন। বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন জেলা প্রাণি কর্মকর্তা ডা. মো. মাহবুবুল আলম ও উপজেলা প্রাণিসম্পদের ভেটেনারি সার্জন ডা. নাজমুল আলম।
১ অক্টোবর ছিল শিক্ষার্থীদের সমাপনী দিন। তাই দুই কর্মকর্তা ইন্টার্নি শিক্ষার্থী আল-আমিন, কায়সার, শুভ, ইসমাঈল, শাম্মী, সাবিনা সহ অন্যান্যদের নিয়ে হাঁসের গ্রামখ্যাত হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার ভাটিপাড়ায় যান। সেখানে সরেজমিন ধানের তুষ দিয়ে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর পদ্ধতি দেখে অভিভূত হন।
প্রথমে ঘর তৈরি, তারপর এ ঘরে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় সিলিন্ডার। বাঁশ দিয়ে বেড নির্মাণ করে ডিম ক্রয় করা হয়। ক্রয় করে নিয়ে আসা হয় ধানের তুষ ও গরম কাপড়। সবকিছু প্রস্তুতের পর ডিম থেকে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোতে জড়িয়ে পড়েন ভাটিপাড়ার ১৫০ পরিবার।
এরপর ১৮ দিন ডিমগুলো সিলিন্ডারে রাখা হয়। অন্য সিলিন্ডারে দেওয়া হয় তুষের আগুন। এখানে আবার তাপমাত্রা বেড়ে গেলে নামিয়ে মাটিতে কিছু সময় রাখা হয়। ১৮ দিন পূর্ণ হলে ডিমগুলো তুষ বেষ্টনী বেডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেস্থানে আরো ১২ দিন রাখার পরে বাচ্চা জন্ম নেয়।
এসব বাচ্চা বিক্রি করেন হয় খামারীদের কাছে। প্রতিটি ডিম কেনেন ১২ টাকায়। আর বাচ্চা বিক্রি করেন ২৫/৩০ টাকায়। এতে তাদের ভালই আয় হচ্ছে।
ভাটিপাড়ার এ নিয়ে সহদেবের সঙ্গে আলাপ হয় ইন্টার্নি শিক্ষার্থীদের। সহদেব জানান, নিজের মেধা আর চেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে নিজের ঘরে ধানের তুষ দিয়ে ডিম থেকে হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে সফল হয়েছেন তিনি। বাচ্চা বিক্রি করে মোটামুটি ভাল আয় হচ্ছে তার। ঘর পাকা করেছেন। সন্তানরা লেখাপড়া করছে। জমি কিনেছেন। তিনি বলেন, ‘আরও এগিয়ে যেতে চাই।’
সহদেব বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনে হাঁসের বাচ্চা এখানের বেকার সমস্যা সমাধান করছে। তা না হলে এ বেকার যুবকদের শুধু মাছ শিকার করতে হতো।’
সহদেব বলেন, ‘আর্থিক সহায়তা পেলে এখানের লোকজন নিয়ে বৃহৎ শিল্পে গড়ে তোলা সম্ভব। অর্থ পেলে প্রথমেই মাটি দিয়ে জমি ভরাট করে আলাদা শেডঘর নির্মাণ করা হবে। এসব ঘরে সিলেন্ডার ও বেড নির্মাণ করে এক সঙ্গে ১০/২০ লাখ ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর ব্যবস্থা করব। এতে আর্থিকভাবে আরও স্বাবলম্বী হবে এখানের মানুষ।
ভাটিপাড়ার সুপ্রতি রাণী, রানু বালা, নিরঞ্জন দাশ, ক্ষিরত দাশও এমনই অভিমত ব্যক্ত করেন। তাদের মতে, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ ও কেমিক্যাল ছাড়া নিজস্ব পদ্ধতিতে তুষ দিয়ে হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে খামারীদের কাছে বিক্রি করছি। এতে করে দিন দিন হাঁস বাচ্চা উৎপাদন বেড়েই চলেছে। কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের ছেলে মেয়েদের দূরদুরান্তে যেতে হচ্ছে না। ঘরে বসেই কর্মসংস্থান হচ্ছে। আমাদের ফোটানো হাঁসের বাচ্চা পালনের মাধ্যমে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে।’
প্রবীণ চন্দ্র দাশ ভাটিপাড়া থেকে বাচ্চা কিনে ৪টি হাঁসের পাল গড়ে তুলেছেন। প্রায় ১০ হাজার হাঁসের মাধ্যমে গড়ে তোলা তার খামারটি এ এলাকার মধ্যে সর্ববৃহৎ। তিনি শ্রমিক দিয়ে এই খামার পরিচালনা করেন। মাসে তিনি লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন।
ভাটিপাড়া পরিদর্শনের পর জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মাহবুবুল আলম বলেন, ‘হবিগঞ্জ জেলায় রয়েছে হাওর-পাহাড়। এখানে হাঁসের প্রাকৃতিক খাবার বেশি। তাই ভাটিপাড়া থেকে বাচ্চা ক্রয় করে বেকাররা খামার করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘ভাটিপাড়ায় গ্যাস-বিদ্যুত ও কেমিক্যাল ছাড়া বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করে তুষ দিয়ে ডিম থেকে হাঁসের বাচ্চাগুলো ফোটানো দেখতে পেরে ভাল লাগছে। আমাদের পক্ষ থেকে এখানে সব ধরণের সার্বিক সহযোগীতা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও করা হবে।’
পরে তারা ভাটিপাড়া থেকে শায়েস্তাগঞ্জ ডাক রিয়ারিং ইউনিট পরিদর্শন করেন। আলাপকালে ভেটেনারী শিক্ষার্থীরা জানান, ভাটিপাড়ায় মান্দাতার আমলের পদ্ধতি আর ডাক রিয়ারিং ইউনিটে আধুনিক ব্যবস্থায় হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর বিষয়টি জানতে পেরে আমরা অভিভূত হয়েছি।