যদি জেলে যেতে হয় যাব সিদ্ধান্তে অটল থাকব : এরশাদ
সাবেক এই রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েও তার মন খারাপ। প্রধানমন্ত্রী তাকে দূত বানিয়েছেন। পতাকা দিয়ে সম্মানিত করেছেন। কিন্তু হাতে কোনো কাজ দেননি। কাজ থাকলে তিনি কাজ করতেন। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার থেকে বেরিয়ে আসার কথা মুখে বলা যত সহজ, পদত্যাগ করে সরকার থেকে বেরিয়ে আসাটা ততটা সহজ বিষয় নয়। এর জন্য সময় প্রয়োজন। তবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি সময় চেয়েছেন। সময় পেলে আলোচনা করে পদত্যাগের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আগাম জাতীয় নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বলে অভিমত দিয়েছেন। তবে আগাম নির্বাচন হলেও বিএনপি বাইরে থাকবে বলে তিনি মনে করেন। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি এককভাবেই নির্বাচন করবে। এছাড়া তিনি রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নে খোলামেলা জবাব দিয়েছেন।
সাক্ষাৎকারটি হুবহু নিচে তুলে ধরা হল।
প্রশ্ন : ছোট ভাই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করার মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনলেন। হঠাৎ করে কেন এই পরিবর্তন?
এরশাদ : দল পরিচালনা করতে গিয়ে নানা সময়ে নানা পরিবর্তন আনতে হয়। এটা দোষের কিছু নয়। বড় প্রায় সব দলেই নানা সময়ে পরিবর্তন হয়েছে। নেতৃত্বে রদবদল হয়েছে। জাতীয় পার্টিতেও হয়েছে। দলের স্বার্থে, দলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এই পরিবর্তন এবং রদবদল করা হয়ে থাকে। আমিও করেছি। এর আগে একবার প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছি। দলের প্রয়োজনেই করেছি। কই, তখন তো ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে এতো কথা হয়নি। তাহলে এখন এতো কথা হচ্ছে কেন? আর এবার তো পার্টিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনিনি। কেবলমাত্র জিএম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান বানিয়েছি। আমার বয়স হয়েছে। চাইলেই আগের মতো গ্রামেগঞ্জে ছুটে যাওয়া সম্ভব না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে গিয়ে যে কাজগুলো আমার পক্ষে এখন আর আগের মতো করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, আমার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জিএম কাদের সেই কাজগুলোই করবেন। এজন্য তাকে এ পদে বসানো।
প্রশ্ন : পার্টির গঠনতন্ত্রে তো কো-চেয়ারম্যান পদ বলে কিছু নেই। তাহলে এই পদের স্থান কীভাবে হবে?
এরশাদ : হ্যাঁ, নেই। কিন্তু গঠনতন্ত্রে আমাকে সেই ক্ষমতা দেয়া আছে। সাংগঠনিক প্রয়োজনে আমি চাইলে যে কোনো পদ সৃষ্টি করতে পারি এবং সেই পদে কাউকে নিয়োগ দিতে পারি। অতীতেও দিয়েছি। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে অতিরিক্ত মহাসচিবের পদ নেই। এ সত্ত্বেও সাংগঠনিক প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় নাজিউর রহমান মঞ্জুর, আনোয়ার হোসেন এবং আহসান হাবিব লিংকনকে অতিরিক্ত মহাসচিব করেছি। তখনও এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। আর আমি বলেছি, আগামী কাউন্সিলে এই পদ সৃষ্টি করা হবে।
প্রশ্ন : মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনার কারণ কী?
এরশাদ : আমি মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনতে চাইনি। জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলুকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি। তাকে আমি মন্ত্রী বানিয়েছি। সে শুরু থেকেই দলে আছে। প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিল। পার্টিকে শক্তিশালী করতে ভাবলাম, মহাসচিব পদে পরিবর্তন এনে দেখি। তাই তাকে মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়েছি। প্রায় দুই বছর সময় দিয়েছি। কিন্তু সে দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তার কোনো যোগাযোগ নেই, সম্পর্কও নেই। জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু মহাসচিব থাকা অবস্থায় ৪০টির বেশি জেলায় জাতীয় পার্টির সম্মেলন হয়েছে, একটিও সে একা করতে পারেনি। সব জায়গায় আমাকেই যেতে হয়েছে। মহাসচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর গত বছর পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পল্টনে মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ হলেও সেই মহাসমাবেশে লোকজন আনতে ব্যর্থ হয় সে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হল, সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচনও হয়েছে। কিন্তু মহাসচিব হিসেবে সে সক্রিয় না থাকায় কোথাও আমরা ভালো করতে পারিনি। তবুও তাকে বদলাতে চাইনি। আমি চেয়েছি জিয়াউদ্দিন বাবলু মহাসচিব পদে থাকুক। এ পদে যদি পরিবর্তন আনতেই হয় তাহলে কাউন্সিলে সবার মতামত নিয়ে পরিবর্তন আনব। কিন্তু তার আগেই সে এমন কিছু কাজ করে বসল, তখন আর তাকে সরানো ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। আমি জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করার পাশাপাশি পার্টির সম্মেলন আয়োজনের জন্য তাকে প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করেছি। সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সদস্য সচিব করেছি। কিন্তু জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু এই সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে একক সিদ্ধান্তে আমার স্ত্রী রওশন এরশাদকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করল। সে আমার সিদ্ধান্তের প্রতি একরকম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল, যা করার এখতিয়ার তার নেই। তখন পার্টির শৃংখলা রক্ষার স্বার্থেই তাকে সরানোটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলুকে সরিয়ে এ পদে আবার আগের মহাসচিবকেই কেন বসালেন?
এরশাদ : এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার অনেক দক্ষ, যোগ্য এবং বিশ্বস্ত। আর্থিকভাবেও সচ্ছল। মহাসচিব পদ থেকে তাকে সরানোর পর সে আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি। আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে সে পার্টিতেই ছিল। তাই তাকেই যোগ্য মনে করেছি এ পদের জন্য।
প্রশ্ন : রংপুরে বসে কেন জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান বানানোর ঘোষণা দিলেন, ঢাকায় নয় কেন?
এরশাদ : মনে রাখতে হবে, রংপুর হচ্ছে জাতীয় পার্টির দুর্গ। তাই এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রংপুরের মানুষের মতামত নেয়াটা জরুরি ছিল। মতামত পাওয়ার পর তাই আর দেরি করিনি। ঘোষণা দিয়ে দিয়েছি। রংপুরের মানুষ মনে করে, এই সিদ্ধান্ত মানে তাদেরই সিদ্ধান্ত। ঢাকায় বসে এ রকম একটি সিদ্ধান্ত দিলে তারা কষ্ট পেতেন।
প্রশ্ন : অনেকেই বলছেন, পার্টিতে অনেক যোগ্য নেতা থাকা সত্ত্বেও ছোট ভাই হওয়ার কারণেই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করেছেন। আপনিও পরিবারের বাইরে যেতে পারেননি। আসলেই কি তাই?
এরশাদ : ছোট ভাই হিসেবে নয়, জিএম কাদের যোগ্য। তার সাংগঠনিক দক্ষতাও অনেকের চেয়ে বেশি। সে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিল। মন্ত্রী ছিল। মন্ত্রী থাকার সময় বেশ দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সততা নিয়ে কাজ করেছে। দলে এবং দলের বাইরে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। তাই তাকে কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ করে কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছি। দলের স্বার্থেই এটা করেছি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সে ক্ষমতা আমার আছে। আর পরিবার? এই উপমহাদেশে পারিবারিক রাজনীতির চল তো বহুদিন থেকেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে আসা হচ্ছে। খালেদা জিয়া তার ছেলেকে রাজনীতিতে এনেছেন। শেখ হাসিনাও তার ছেলেকে রাজনীতিতে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জিএম কাদের আমার ছোট ভাই। আর ছোট ভাই যোগ্য-দক্ষ হলে সে কেন বঞ্চিত হবে? আমি তার মধ্যে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ দেখি। মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। আমিও থাকব না। কিন্তু আমি চাই, আমি না থাকলেও জাতীয় পার্টি যেন বেঁচে থাকে। তাই আমার বিশ্বাস, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের অবর্তমানে জিএম কাদের জাতীয় পার্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। সে যোগ্যতাও তার আছে।
প্রশ্ন : পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত অটল থাকতে পারবেন?
এরশাদ : মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এই সিদ্ধান্তে অটল থাকব। আর এই পরিবর্তন নেতাকর্মীরা মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছে। দলে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে আশার আলো দেখা দিয়েছে। তাই এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত আর বদলানোর সুযোগ নেই।
প্রশ্ন : অনেকেই মনে করছেন, এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আপনি বড় ধরনের একটি ঝুঁকি নিয়েছেন। তাই যদি হয়, তাহলে শাসক দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে নতুন করে কোনো রোষানলে পড়ার আশংকা কি করছেন?
এরশাদ : না, এমন আশংকা নেই। যতটুকু জানি, আওয়ামী লীগের শীর্ষ র্পর্যায়ের নেতারাও চান জাতীয় পার্টি এগিয়ে যাক। শক্তিশালী হোক এবং কার্যকর বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করুক। কারণ, বিএনপি বলে দেশে এখন কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব নেই। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হলে তাদের জন্যই মঙ্গল। আর রাজনীতি করতে হলে ঝুঁকি নিয়েই করতে হয়। ঝুঁকি নিয়েই আমি ’৯৬ সালে কারাগারে থেকে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছি। ঝুঁকি নিয়ে মহাজোট গঠন করেছি। সব দল যখন নির্বাচন বর্জন করেছে, তখন ঝুঁকি নিয়েই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছে। ফলে কী আর হবে এখন? মাথার ওপর এখনও দুটি মিথ্যা মামলা ঝুলছে। এ নিয়ে এখন আর ভাবি না। যা ভাগ্যে আছে তা হবে। আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। এই বয়সে আবার যদি জেলে যেতে হয়, যাব। যা কপালে আছে মেনে নেব। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ঝুঁকি যদি নিয়েই থাকি তাহলে এই ঝুঁকি নেয়ায় আমার দলের নেতাকর্মীরা খুশি হয়েছে। দলে নতুন করে প্রাণ ফিরে এসেছে।
প্রশ্ন : আপনি প্রায় সময় বলে থাকেন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিন্তু কী সেই ষড়যন্ত্র, আর তা কি অব্যাহত আছে?
এরশাদ : হ্যাঁ, জাতীয় পার্টিকে নিয়ে অতীতে বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবে এখন ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে আমি মনে করি না। আর ষড়যন্ত্র করে লাভ নেই। অতীতে যারা পার্টি নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছেন, তারা নিজেরাই ছিটকে পড়েছেন। হারিয়ে গেছেন। জাতীয় পার্টি টিকে আছে, টিকে থাকবে।
প্রশ্ন : আপনি বহুবার সরকার থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। এটা কি আপনার কথার কথা, না সত্যিই আপনি সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে চান?
এরশাদ : আমি সত্যিই সরকার থেকে বেরিয়ে এসে কার্যকর এবং শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাই। আমার স্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও তাই চান। একইসঙ্গে সরকারে এবং বিরোধী দলে থাকায় মানুষ আমাদের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। আমাদের ওপর আস্থা রাখতে চায় না। তাই সরকার থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। কিন্তু চাইলেই তো সব হয় না। পদত্যাগ করে সরকার থেকে বেরিয়ে আসার কথা মুখে বলা যত সহজ, পদত্যাগ করে সরকার থেকে বেরিয়ে আসাটা ততোটা সহজ বিষয় নয়। এর জন্য সময় প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় বিশেষ দূত বানিয়ে সম্মানিত করেছেন। আমার দলের তিনজন প্রেসিডিয়াম সদস্যকে তিনি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছেন। এ অবস্থায় হুট করে পদত্যাগ করে আসা যায় না। তাকে অসম্মানিত করাও ঠিক হবে না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য আমি তার সঙ্গে দেখা করব। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েছি। তিনি সময় দিলে এ নিয়ে কথা বলব। তার সঙ্গে আলোচনা করে পদত্যাগের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।
প্রশ্ন : তাহলে আপনি এবং আপনার মন্ত্রীরা সহসা পদত্যাগ করছেন না?
এরশাদ : হ্যাঁ, মন্ত্রিসভা থেকে জাতীয় পার্টি পদত্যাগ করবে। তবে তাড়াহুড়া করে নয়, অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেব।
প্রশ্ন : প্রধানমন্ত্রী আপনাকে বিশেষ দূত বানিয়েছেন, তার বিশেষ দূত হয়ে কী করলেন এই দুই বছরে?
এরশাদ : তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাকে দূত বানিয়েছেন, পতাকা দিয়েছেন। সম্মান দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ দেননি। কাজ দিলে কাজ করতাম। কিন্তু কাজ না দেয়ায় এ নিয়ে আমার মনে একটা দুঃখ তো আছেই।
প্রশ্ন : সেই দুঃখ থেকেই কি পদত্যাগের কথা বলছেন?
এরশাদ : ঠিক তা নয়। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে চাই দলের স্বার্থে।
প্রশ্ন : এখন আপনি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছেন, ভবিষ্যতে কি সংসদ থেকেও পদত্যাগ করার কথা ভাবছেন?
এরশাদ : না। পাগল নাকি। আমরা শেষ দিন পর্যন্ত এই সংসদে থাকব। আমরা পূর্ণ মেয়াদেই সংসদে থাকব। সরকারকেও পুরো মেয়াদ সময় দেব। আমাদের স্বার্থেই তাদের সময় দেব। পাঁচ বছর মেয়াদি সরকারের মাত্র দুই বছর গেল। হাতে আরও তিন বছর আছে। এই তিন বছরে আমরা দলকে সংগঠিত এবং শক্তিশালী করব। প্রার্থী ঠিক করব। আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেব। এর জন্য আগামী তিন বছর যথেষ্ট সময়। আমরা এই সময়টাকে কাজে লাগাতে চাই।
প্রশ্ন : দলে আপনার সঙ্গে স্ত্রী রওশন এরশাদের বিরোধের বিষয়টি সব সময় আলোচিত। কিন্তু কেন এই বিরোধ? দু’জনের মধ্যে সমঝোতাই বা কতটা স্থির?
এরশাদ : রওশন এরশাদের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। বিরোধের সুযোগও নেই। যা বলা হয়, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। আমি দলের চেয়ারম্যান। দল চালাই। তিনি বিরোধীদলীয় নেতা। সংসদ চালান। তিনি সুখে দুঃখে আমার সঙ্গে ছিলেন, পাশে ছিলেন। ভবিষ্যতেও থাকবেন। দু’জনের মধ্যে সমঝোতা আছে বলেই ক্ষমতার বাইরে থেকেও আমরা এতটা বছর একসঙ্গে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে এগিয়ে চলছি। তবে হ্যাঁ, এটা সত্য যে, অনেকেই আমাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি করার চেষ্টা করেন। তাদের এই চেষ্টা অতীতেও সফল হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।
প্রশ্ন : অভিযোগ আছে, জিএম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান করার বিষয়টি রওশন এরশাদ মেনে নেননি। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এরশাদ : না, এটা ঠিক না। তিনি চান তাকেও যাতে আমি পার্টির কো-চেয়ারম্যান করি। তিনি (রওশন এরশাদ) এক নম্বর, জিএম কাদের দুই নম্বর কো চেয়ারম্যান। এই ছিল তার প্রস্তাব। আমি এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে তার প্রস্তাবটি খারাপ না। তাকে এক নম্বর কো-চেয়ারম্যান করা যেতেই পারে। পরে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।
প্রশ্ন : মহাসচিব পদে পরিবর্তন কি রওশন এরশাদ মেনে নিয়েছেন?
এরশাদ : হ্যাঁ, মেনে নিয়েছেন। যতটুকু জানি তিনিও রুহুল আমিন হাওলাদারকে পছন্দ করেন।
প্রশ্ন : সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। দলের এই পরিবর্তন নির্বাচনে কি কোনো প্রভাব ফেলবে?
এরশাদ : আশা করি, এবার আমরা ভালো করব। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে। ’৯০-এর পর আমরা রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে। নেতাকর্মীরা গরিব হয়ে গেছে। তাদের হাতে টাকা নেই। এখন নির্বাচন মানেই অনেক খরচ। শুধু জনপ্রিয়তা থাকলেই হয় না। অর্থও লাগে। এক লাখ টাকা করে দিলেও অনেক টাকা। এতো টাকা আমার নেই। এই অবস্থায় নির্বাচন করে জয়ী হয়ে আসাটা সত্যিই কঠিন। তবুও আমি আশাবাদী, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমরা ভালো করব।
প্রশ্ন : আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে আছে? কতটা তিক্ত কিংবা কতটা মধুর?
এরশাদ : যে কোনো সম্পর্কেই তিক্ত এবং মধুর দুটো দিকই থাকে। আমাদের সঙ্গে বরাবরই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। আমরা সব সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ছিলাম, এখনও আছি। যদিও মহাজোট গঠনের সময় তারা আমাদের যতগুলো আসন দেয়ার কথা দিয়েছিল, তা দেয়নি। সেই দুঃখ তো আছেই। তবুও আমি মনে করি, বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ অনেক ভালো। বিএনপি দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ অন্তত তা করেনি।
প্রশ্ন : কেউ কেউ বলছেন বিএনপির সঙ্গেও গোপনে যোগাযোগ রয়েছে আপনার। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভবিষ্যতে বিএনপির সঙ্গে জোট করার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা?
এরশাদ : না, বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বিএনপির সঙ্গে জোট করারও কোনো সম্ভাবনা নেই। আর বিএনপির নিজেদেরই তো কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা নিজেরাই এখন কোনোভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কী লাভ? দুর্বলের সঙ্গে কেউ হাত মেলায় না।
প্রশ্ন : বিএনপিসহ তাদের শরিকরা বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন দাবি করছে। আপনিও আগাম নির্বাচন দাবি করেন কিনা?
এরশাদ : না, আমরা আগাম নির্বাচন চাই না। আমরা চাই, মেয়াদ শেষে যথানিয়মে নির্বাচন হোক। আর বিএনপিসহ তাদের শরিকরা কী চাইল তাতে কিছু যায় আসে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও তাদের কথা আমলে নেবে না। কারণ তারা জানে, বিএনপির আন্দোলন করে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষমতা নেই। তাদের সেই শক্তিও নেই।
প্রশ্ন : ক্ষমতাসীনরা যদি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আগাম নির্বাচন দেয়, আপনি তখন কী করবেন? সেই নির্বাচনে কি অংশ নেবেন? নিলে এককভাবে না জোটগতভাবে নেবেন?
এরশাদ : জাতীয় পার্টি বরাবরই একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। নির্বাচন বর্জনের রেকর্ড নেই আমাদের। যদিও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। আমি চেয়েছিলাম সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন। কিন্তু বিএনপিসহ তাদের শরিকরা এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় আমরা এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না গেলে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। গণতন্ত্র ব্যাহত হওয়ার আশংকা থাকত। আমরা নির্বাচনে অংশ নেয়ায় শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র রক্ষা পেয়েছে। নির্বাচনে অংশ না নিলেও বিএনপি বর্তমান সরকারের পথচলা বারবার ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। সরকার তার মেয়াদ পূরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমি আগাম নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। যদি হয়, তাহলে সেই নির্বাচনেও বিএনপি বাইরে থাকবে। আর বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টি এককভাবেই নির্বাচন করবে। বিএনপি এলে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে ভবিষ্যতের ওপর। এখনই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা কঠিন।
প্রশ্ন : জাতীয় পার্টিকে নিয়ে এই মুহূর্তে কী ভাবছেন?
এরশাদ : মাঝখানে জাতীয় পার্টির কর্মকা- স্থবির হয়ে ছিল। ‘না সরকারি দল-না বিরোধী দল’- এমন অবস্থানের কারণে নেতাকর্মীরাও হতাশার মধ্যে ছিল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কো-চেয়ারম্যান নিয়োগসহ মহাসচিব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন লক্ষ্য- নতুন নেতৃত্বের হাত ধরে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এপ্রিলে দলের কাউন্সিল। সফলভাবে কাউন্সিল সম্পন্ন করার পর দল গোছাতে আমি নিজেও গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াব। পার্টিকে নতুন করে সংগঠিত এবং শক্তিশালী করতে চাই। আগামী নির্বাচন আমার জীবনের শেষ নির্বাচন। শেষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলকে ক্ষমতায় নিতে চাই।
সৌজন্যে দৈনিক যুগান্তর