গুলশান, বনানী, বারিধারায় থাকা সাধারণ মানুষের খুব কষ্ট এখন। কর্তৃপক্ষ হয়তো ধরে নিয়েছেন এখানে যারা বাস করেন তারা সবাই মিলিয়নিয়ার বা বিলিয়নিয়ার। সবারই গাড়ি আছে, সবাই দেশ বিদেশে যখন তখন যাতায়াত করে। তাই হঠাৎ করে সব ধরনের পাবলিক যানবাহন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। যাদের গাড়ি নেই, তারা প্রতিদিন এখন পায়ের উপর ভরসা করেই মাইলের পর মাইল হাঁটছেন আর নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছেন।
যারা এখানে নানা কাজে আসেন তারা আছেন আরো বিপদে। তবে সবচেয়ে অবাক করা কাণ্ড হলো হঠাৎ করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হওয়া। রাজউকের বোল্ডোজার প্রতিদিনই ভাঙ্গছে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। হলি আর্টিজান হামলার পর থেকেই একটা থমথমে পরিস্থিতি এই এলাকায়। এখন পুলিশ আর রাজউকের অ্যাকশানে পরিস্থিতি আরো বিদঘুটে। নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না, পুলিশের সরব উপস্থিতিও মানুষকে ভরসা দেয় অনেকখানি। কিন্তু যদি ভয় পাইয়ে দেয়া হয় তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? জঙ্গিদের অনেক মিশনের একটা হলো মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়া, সমাজে সাধারন আতংক তৈরি করা। যদি সরকারি প্রশাসনই একাজ করে তাহলে জঙ্গিদের উদ্দেশ্য সফলই বলতে হবে।
আজ আকস্মিকভাবে রাজউক জেগে উঠেছে অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে। এগুলো যখন গড়ে উঠেছিল তখন কোথায় ছিলেন এই মহান প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা? এই এলাকার অনেকগুলো রেস্তোরাঁ বিশ্বমানের। এসবে স্থানীয়দের পাশাপাশি অনেক বিদেশি নাগরিকরা আসতেন। একটি ঘটনায় বিদেশিরা আতংকগ্রস্ত হয়েছে একথা ঠিক, কিন্তু তাদের ভেতরতো আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। একদিকে আমরা বলছি বিদেশিরা আসুন, ভয় নেই। অন্যদিকে আমরা তাদের চলাচলের জায়গাগুলো ক্রমেই সংকুচিত করে আনছি। যারা এসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন তারা কি অপরাধ করেছেন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কাজে অর্থ ব্যয় করে, শ্রম সৃষ্টি করে? বেকারের দেশে কতনা মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানে এখানে কাজ করতেন। তারা কোথায় যাবেন?
নিশ্চয়ই কেউ অবৈধ স্থাপনার পক্ষে সাফাই গাইবে না। কিন্তু এমন ঢালাও উচ্ছেদও কি আমাদের কাম্য? জঙ্গিদের মননহীন হত্যালীলায় বলি হয়েছেন বিদেশিরা, স্থানীয়রা। কিন্তু এখন কর্তৃপক্ষীয় এমন কাজে বলি হচ্ছে শত শত মানুষ। আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই, কিন্তু স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সাথে এমন আচরণ কখনোই বিদেশিদের আস্থা দেবে না, সেটা কতটা বুঝি?
গুলশান হামলার পর রাজধানীতে নিরাপত্তাব্যবস্থার চিত্রই পাল্টে গেছে। সড়ক ও ভবনে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। একাধিক চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এসবই ভাল উদ্যোগ। মানুষ নিরাপত্তা চায়, ভয়হীন পরিবেশ চায়, কিন্তু একই সাথে কাজও চায়, অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য চায়।
এই জঙ্গি হামলার ভয়াবহ ব্যবসায়িক মন্দার কবলে পড়েছে দেশের পাঁচ তারকামানের হোটেল ও অভিজাত রেস্তোরাঁগুলো। নিরাপত্তা শংকায় বিদেশী নাগরিকদের বাংলাদেশ সফর স্থগিত, সম্ভাব্য আগন্তুকদের একের পর এক বুকিং অর্ডার বাতিল এবং অবস্থানরত বিদেশীদের হোটেলমুখী না হওয়াই এর মুখ্য কারণ। একই সঙ্গে দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও বিত্তবানদের ঝাঁকজমকপূর্ণ সেলিব্রেশন অনুষ্ঠান আয়োজনেও ভাটা পড়েছে। এতে করে দেশের আন্তর্জাতিকমানের সব ক’টি হোটেল ও রাজধানীর অভিজাত এলাকার মানসম্পন্ন রেস্তোরাঁগুলোর ব্যয়বহুল কর্মকাণ্ড পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্রেতার অভাবে রাজধানীর অভিজাত রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার নেতিবাচক ধাক্কা এসে পড়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়। ঝড়ো হাওয়ার মতোই যেন তাদের সবকিছু উড়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যেখানে দিনভর ক্রেতার পদচারণায় কর্মচারীদের অবসর পাওয়ার ফুরসত ছিল না, এখন সেই ক্রেতার অভাবে এসব আন্তর্জাতিকমানের হোটেল ও অভিজাত রেস্তোরাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। অনেক অভিজাত রেস্তোরাঁ ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। নতুন করে বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন অনেকে। গুলশান হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে তা সহজে পূরণ করার মতো নয়। গুলশানের দুঃস্বপ্ন আমাদের প্রতিমুহূর্তেই তাড়া করবে। এই ভয়কে হারাতে হবে আমাদের। মাথা ব্যথার সমাধান নিশ্চয়ই মাথা কাটা নয়।
গুলশান বনানীর সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উঠিয়ে দেয়া হবে, এমন একটি ধারণা চাউর হয়ে গিয়েছে, যা ব্যবসায়ী, বিনিযোগকারীদের আস্থার সংকটে ফেলবে। নামী দামি প্রতিষ্ঠানসহ হাজারখানেক প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসছে তালিকায়। এটা বিকাশমান অর্থনীতির উপর একটি আঘাত। নীতি নির্ধারকরা বুঝবেন আশা করি যে অর্থনীতি বিকাশের সময় তাকে আঘাত করতে হয় না, শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কৌশল নিতে হয় ।
আরটিজানে জঙ্গি হামলার মত আরও হামলা যেন না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় বাহিনীকে আরও সুদক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি করে নয়। বড় শহরে আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা ভিন্ন হয় কিন্তু ছোট দেশের রাজধানী ঢাকায় এতো জায়গাও নেই আর অবকাঠামোও নেই যে সব কিছু আলাদা স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে।
মানুষ যা কিছু করে তার চাহিদা ও প্রয়োজন থেকে করে। সেবামুলক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আবাসিক এলাকার ক্ষতি করে না। কূটনৈতিক এলাকায় কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকবে না এটা ঠিক আছে। কিন্তু পুরো গুলশান ও বনানী এলাকা কূটনৈতিক এলাকা নয়। মানুষ তার চাহিদা ও প্রয়োজন থেকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও বিনোদন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। জঙ্গি সমস্যা রাজনৈতিক কিন্তু আঘাত হচ্ছে অর্থনীতিতে। অর্থনীতিকে ক্ষতি করলে রাজনৈতিক সমস্যা বরং বাড়বে।