নানা সূত্রে শুনেছেন বলেই হয়তো ধারাভাষ্যকররাও বলতে থাকলেন, তামিম ইকবাল আর নামছেন না! ক্লোজ আপে বারবার বাংলাদেশ ওপেনারের ম্লান মুখটা দেখাচ্ছে। স্লিংয়ে হাত ঝোলানো, পাশে বসা ফিজিও থিলান চন্দ্রমোহন। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানটি ড্রেসিংরুমে বসে আছেন অথচ ব্যাটিংয়ে নামতে পারছেন না—প্রতিপক্ষের জন্য কতটা স্বস্তির খবর!
আর সবার মতো শ্রীলঙ্কা দলও নিশ্চিত ভেবেছে তামিম আর নামছেন না। তারা ভেবেছে, লোয়ার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের দ্রুত ফিরিয়ে দিতে পারলে চ্যালেঞ্জিং স্কোর পাওয়ার আগে বাংলাদেশকে গুটিয়ে দেওয়া কঠিন হবে না। সেটা তারা অনেকটা পেরেছেও। মুশফিক-মিঠুনের ১৩১ রানের জুটি ভাঙার পর আর লম্বা কোনো জুটি হতে দেয়নি বাংলাদেশকে। ২ উইকেটে ১৩৪ থেকে ৫ উইকেটে ১৪২—৮ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারানো বাংলাদেশের ২০০ রান করা নিয়েই সংশয়।
এটা ঠিক, মুশফিকুর রহিম একা লড়ছেন। কিন্তু একা কতক্ষণ? নড়বড়ে নব্বইয়ে পৌঁছে মুশফিকের আত্মবিশ্বাসে যে খানিকটা ধাক্কা খেয়েছিল সেটি তাঁর ব্যাটিং দেখে বোঝা যাচ্ছিল। শ্রীলঙ্কা তখন টগবগে আত্মবিশ্বাসে চেপে ধরেছে বাংলাদেশকে। দাঁতে দাঁত কামড়ে লেজের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে মুশফিক তবুও তিন অঙ্ক ছুঁলেন। ব্যক্তিগত প্রাপ্তি যথেষ্ট কিন্তু দলের স্কোরটা কি ভালো হলো?
তামিম যেহেতু নামছেন না, ৯ উইকেটে ২২৯ রানেই বুঝি থামল বাংলাদেশ। সে কী, ১১২ রানে অপরাজিত মুশফিক ড্রেসিংরুমে ফিরছেন না! সবিস্ময়ে সবাই দেখল, হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে নামছেন তামিম! সিদ্ধান্তটা কার মস্তিষ্কপ্রসূত, এখন বলার উপায় নেই। তবে বাংলাদেশের এ কৌশলটাই বদলে দিয়েছে পুরো ম্যাচের চেহারা। চমকে দিয়ে শেষ উইকেট হিসেবে আবারও নামলেন বাংলাদেশ ওপেনার। ৯ উইকেটেই বাংলাদেশ ভালো স্কোর পেয়ে গেলে হয়তো তামিম নামতেন না। বাংলাদেশের স্কোর যাচ্ছেতাই হলেও হয়তো তামিমকে নামানোর ঝুঁকি নিত না বাংলাদেশ। দুই–তিন মাসের জন্য তামিম যে দলের বাইরে চলে গেলেন!
স্কোরটা যখন হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছিল না, বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট ভেবেছে, তামিম যদি শুধু মুশফিককে সঙ্গ দিতে পারেন আর তাতে যত রান আসে সেটিতেই লাভ। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা তামিমকে নিতে হয়েছে, এটা নিশ্চিত। দল নিশ্চয়ই তাঁর ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়নি। আর তামিম শুধু ব্যাট হাতে নেমে পড়েছেন, এটাই মানসিকভাবে কী অবিশ্বাস্য জ্বালানি জুগিয়ে দিল বাংলাদেশকে। যেন মহাকাশ ফুঁড়ে ছুটে চলার জন্য রকেটের উৎক্ষেপণ।
তামিমের কাজ অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা আর মুশফিক চালিয়ে যাবেন—এই কৌশল বাস্তবায়নে অবশ্য তামিমের সিদ্ধান্তটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে তিনি কি ফের ব্যাটিংয়ে নামবেন? তখন এমনই পরিস্থিতি, তাঁকে নেমেই অন্তত একটা বল খেলতে হবে। নেমেছেন। খেলেছেন। তামিম নামায় দৃশ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বদল এসেছে। মুশফিক হাত খুলে মারার সাহস পেয়েছেন আর খানিকটা বিচলিত হয়ে শ্রীলঙ্কান বোলাররা খেই হারিয়ে ফেলেছেন। লঙ্কান ফিল্ডারদের শারীরিক ভাষাও বলছিল, এই দৃশ্য দেখতে তাঁরা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ৪৯.৩ ওভারে বাংলাদেশ অলআউট হওয়ার আগে শেষ ১৬ বলে যে ৩২ রান (৩২ রানই করেছেন মুশফিক) তুলেছে, সেটিই বাংলাদেশকে যেন ভাবতে সহায়তা করেছে, ‘ম্যাচটা আমরাই জিততে যাচ্ছি!’
তামিম-ফাটকায় এতটা ধাক্কা খেয়েছে, সেটি কাটিয়ে ওঠার সময় পায়নি লঙ্কানরা। যেটির ছাপ পড়েছে তাদের ব্যাটিংয়েও। এসেই এলোমেলো-পরিকল্পনাহীন চালিয়ে খেলতে যাওয়া আর হতশ্রী ব্যাটিংয়ে শ্রীলঙ্কা কীভাবে বাংলাদেশের দেওয়া ২৬২ রানের লক্ষ্য তাড়া করবে? এর মধ্যে ভুল রিভিউ নিলে শ্রীলঙ্কাকে মনে হলো হঠাৎ ভূতে পাওয়া এক দল! প্রতিপক্ষের এ ছন্নছাড়া দশার সুযোগ বাংলাদেশের বোলাররা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন। মেহেদী হাসান মিরাজের করা ১৫তম ওভারে শানাকার তুলে দেওয়া ক্যাচ নাজমুল ইসলাম হাস্যকরভাবে হাতছাড়া করার পরও বাংলাদেশের বড় জয় পেতে সমস্যা হয়নি।
বলা হয়, ক্রিকেট যতটা না স্কিলের খেলা তার চেয়ে বেশি মনস্তাত্ত্বিক। সেই মনস্তাত্ত্বিক খেলায় বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে কিস্তিমাত করেছে এক চালেই। চালটার নাম তামিম ইকবাল! এ সাফল্যে মাশরাফিরা অট্টহাসে ফেটে পড়বেন আরও এক কারণে, চালটা যে দিয়েছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বিপক্ষে, যিনি আবার ‘মাইন্ড গেম’ খেলতে সিদ্ধহস্ত!