প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতা-কর্মীদের আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সতর্ক থাকার পাশাপাশি দল ও সরকারের সাফল্য ভোটারদের সামনে তুলে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এবং দলের বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত আগেও ছিল এবং এখনও ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। তাই আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। বরং এ ধরনের আত্মতুষ্টির জন্য ১৯৯১ সাল এবং ২০০১ সালের মতো আওয়ামী লীগকে যাতে খেসারত দিতে না হয় সে ব্যাপারে নেতা-কর্মীদের সজাগ থাকতে হবে। প্রতিপক্ষকে সব সময় শক্তিশালী মনে করেই চলতে হবে। মনে রাখতে হবে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আগামী নির্বাচনে প্রত্যেকটি আসনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য একযোগে কাজ করতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে যোগদান শেষে সোমবার দেশে ফিরে গণভবনে এসে পৌঁছলে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে আসা দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। সপ্তাহব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র সফরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে যোগদান, বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের ইভেন্টে অংশগ্রহণ এবং বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠককে অত্যন্ত সফল ও ফলপ্রসূ হিসেবে বর্ণনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের হারানো গৌরব পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দেশের মানুষ মর্যাদা ও সম্মান পাচ্ছে। দেশের জনগণ আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছিল বলেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে তিনি বলেন, তাদের আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। দলের সাফল্য সব জায়গায় তুলে ধরতে হবে। ভোটের অধিকার কেবল আওয়ামী লীগই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। পঁচাত্তরের পর থেকেই একটা বৈরী পরিবেশে তার দল সংগ্রাম করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ভোটের রাজনীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকেই এখন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু ভোটের কথা বলেন, কিন্তু তারা জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোটের কথা কী ভুলে গেছেন? আওয়ামী লীগই দেশের মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত সাড়ে নয় বছরে উপ-নির্বাচন, পৌরসভা, মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ দেশে ছয় হাজারের বেশি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কেউ এসব নির্বাচন নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনি। এখন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নেতা-কর্মীসহ দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনসমর্থন ও একের পর এক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে পারায় টানা দুই মেয়াদে দেশের মর্যাদাপূর্ণ সব অর্জন সম্ভব হয়েছে।
শেখ হাসিনা অভিযোগ করে বলেন, তাঁর দলের বিরুদ্ধে তথ্য নিয়ে কয়েকটি পত্রিকা বসেই আছে, নির্বাচনের সময় তারা একটার পর একটা ছেড়ে দেবে। দলের সফল নেতা ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে এরা লেগেই থাকে। তিনি বলেন, যেখানেই আমাদের কোন অর্জন, যেখানেই মানুষ একটা বাহবা দিচ্ছে, সেখানেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটা মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। আর আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের মন্ত্রণালয় থেকেই হোক বা দুর্নীতি দমন কমিশন থেকেই হোক, সেগুলোকে খুব গুরুত্ব দিয়েই আমাদের লোকগুলোর বিরুদ্ধে লেগে যায়। কাজেই এসব ব্যাপারে আমাদের কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বারবার মৃত্যুকে মুখোমুখি নিয়ে অনেকেই চলতে পারে না। সে সাহসও পায় না। তারপর আবার আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মোকাবেলা করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যারা জড়িত ছিল এমন অনেকের বংশধরদের একটা শ্রেণী দেশে রয়ে গেছে। তাদের চক্রান্ত তো অনবরত চলছে। সেখান থেকে একটা শ্রেণী গড়ে উঠেছে, তারা জানেই যে তারা ভোটের রাজনীতিতে পারবে না। তারা জানে যে তারা দল করতে পারে না। তারা মাঠে যেতে পারে না। কিন্তু ক্ষমতার লোভ তাদের। এই ক্ষমতার লোভে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সঙ্গেই তারা হাত মেলায়, খুনীদের সঙ্গে ঘাতকের সঙ্গে হাত মেলায় এবং তারা কিন্তু সারাক্ষণ আমাদের বিরুদ্ধে লেগেই থাকে।
২০০১ সালে গভীর চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি দাবি করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ১৯৯১ সালে এই চক্রান্ত আমার দলের ভেতরেও ছিল, বাইরেও ছিল। দলের ভেতর চক্রান্তটা কোথায়? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক, আমি যেন কিছু না হতে পারি। ওটা করতে গিয়ে এমন প্রার্থীদের বেছে নেয়া হলো, যারা জিতে আসতে পারেনি। তিনি বলেন, এদেশে একটা ষড়যন্ত্র সবসময়ই চলে আসছে যাতে আওয়ামী লীগ অথবা বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না আসতে পারে। তাদের একটাই ভয় তাহলে জনগণ সেই নেতৃত্বের ওপর ভর দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তাই অনেক বাধা-ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আমাদের ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে বলেই দেশ আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদসহ বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠান, কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন অনেক সম্মান পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানগণ তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে আমন্ত্রণ জানান এটা তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, নিউইয়র্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলাপকালে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়া জাতির পিতার খুনী রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন বলে জানান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি এবং রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ কূটনীতি পরিচালনায় অবদানের জন্য ইন্টার প্রেস সার্ভিস এবং গ্লোবাল হোপের কাছ থেকে পাওয়া দু’টি আন্তর্জাতিক দেশের জনগণকে উৎসর্গ করে বলেন, এবারের সফরে অনেক সম্মান পেয়েছি। বিশ্বনেতাদের দেয়া এ সম্মান বাংলাদেশের সম্মান, পুরস্কার দেশের জনগণকে উৎসর্গ করলাম।
এর আগে জাতিসংঘের ৭৩তম অধিবেশনে যোগদান শেষে গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসহ সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। পরে বিমানবন্দর থেকে গণভবনে পৌঁছানোর পর প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ, সভাপতিম-লীর সদস্য, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। গণভবনে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে জš§দিনের শুভেচ্ছাও জানান। গত ২৮ সেপ্টেম্বর তার ৭২তম জš§দিন ছিল।
–