বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রেলযোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যে ৯টি সীমান্তপথে হচ্ছে রেলসংযোগ। এর মধ্যে দর্শনা-গেদে, বেনাপোল-পেট্রাপোল, রহনপুর-সিংগাবাদ ও বিরল-রাধিকাপুর এই ৪টি সীমান্তপথে বর্তমানে ট্রেন চলাচল করছে। এছাড়া শাহবাজপুর-মহিশশান, চিলাহাটি-হলদিবাড়ী ও বুড়িমারী-চেংড়াবান্ধা এই ৩টি রেলপথ সংস্কারে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। নতুন করে আখাউড়া-আগরতলা ও ফেনী-বিলোনিয়া ২টি রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের অর্থায়নে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রেলযোগাযোগ বৃদ্ধিসহ আন্তর্জাতিক ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে রুটে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ অন্য দেশের সঙ্গে রেলপথে পণ্য রপ্তানি-আমদানির সুবিধাসহ যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বৃদ্ধি পাবে বলে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
এ ব্যাপারে রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে রেল চলাচল করত। কিন্তু ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় এই রুটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এই বন্ধ রেললাইন সংস্কার করে পুনরায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেলসংযোগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক রেলরুট ট্রান্স এশিয়া রেলওয়ে সঙ্গে যুক্ত হতে এই রেলপথ ব্যবহার করা হবে। এতে রেলপথে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পণ্য রপ্তানি-আমদানি প্রসার লাভ করবে বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামলে ৮টি স্থান দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে সরাসরি যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করত। এগুলো হলো- বাংলাদেশের দর্শনা ও ভারতের গেদে, বাংলাদেশের বেনাপোল থেকে ভারতের পেট্রাপোল, বাংলাদেশের রহনপুর থেকে ভারতের সিংগাবাদ, বাংলাদেশের বিরল থেকে ভারতের রাধিকাপুর, বাংলাদেশের শাহবাজপুর থেকে ভারতের মহিশশান, বাংলাদেশের চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ী ও বাংলাদেশের বুড়িমারী থেকে ভারতের চেংড়াবান্ধা পর্যন্ত। এ সব রেলরুটের বেশিরভাগেই ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় এ ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দর্শনা-গেদে : বাংলাদেশের দর্শনা থেকে ভারতের গেদে পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার রেলপথ দিয়ে বর্তমানে যাত্রীবাহী ট্রেন এবং ফ্রেট ট্রেন চলাচল করছে। ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ঢাকা-কলকাতা রুটে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করছে। এই রুটটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের অন্তর্ভুক্ত।
বেনাপোল-পেট্রাপোল : বাংলাদেশের বেনাপোল থেকে ভারতের পেট্রাপোল পর্যন্ত ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রুটটি বাংলাদেশ ও ভারতের রেলওয়ের একটি অপারেটিং ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট। ১৯৬৫ সালে পর থেকে এই পয়েন্টটি পরিত্যক্ত ছিল। এরপর ২০০০ সালে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য পুনরায় চালু করা হয়। এছাড়া খুলনা-বেনাপোল-কলকাতা রুটে বন্ধন এক্সপ্রেস নামে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রেলসংযোগসহ আন্তর্জাতিক ট্রান্স এশিয়ান রেলরুটে যুক্ত হবে এই রেলপথ।
রহনপুর-সিংগাবাদ রুট : বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত রহনপুর থেকে ভারতের সিংগাবাদ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথটি। এই রুটে নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট কার্যক্রমের জন্য নেপালের সীমান্ত স্টেশন রাক্সাউল ও জগবাণীর সঙ্গে যথাক্রমে বীরগঞ্জ ও বিরাটনগর স্টেশনের সংযুক্ত। এই রেলপথে বর্তমানে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করছে।
বিরল-রাধিকাপুর রুট : বাংলাদেশের বিরল সীমান্ত থেকে ভারতের বাধিকাপুর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সীমান্ত রেলপথটি ২০০৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে। এই রুটটি ২০০৫ সাল পর্যন্ত নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট কার্যক্রমে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ২০০৫ সালে ভারতের অংশের রেলপথ ব্রডগেজে রূপান্তরিত করায় তা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ অংশে পার্বতীপুর-বিরল বর্ডার পর্যন্ত রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তর করে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল থেকে রেলপথটি চালু করা হয়। এই রেলপথ চালু ফলে ১২ বছর পর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
শাহবাজপুর-মহিশশান রুট : বাংলাদেশের সিলেটের শাহবাজপুর থেকে ভারতের মহিশশান পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সীমান্ত রেলপথটি ২০০২ সালের ৭ জুলাই বন্ধ হয়ে যায়। এই রেলপথে দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করত। এটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে রুট। কুলাউড়া-শাহবাজপুর বর্ডার পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পটি ভারতীয় লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি)’র আওতায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই রেলপথটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী। রেলপথটিকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরিত করে আরও ৯ কিলোমিটার বাড়িয়ে ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত নেয়া হলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আঞ্চলিক ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।
চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুট : বাংলাদেশের চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ী পর্যন্ত ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সীমান্ত রেলপথটি ১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্রডগেজ রেলপথটি নির্মাণে প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এই রেলপথটি নির্মাণ করা হলে ভুটানের সীমান্তবর্তী স্টেশন হাসিমাড়া হতে বাংলাদেশের মংলাবন্দর পর্যন্ত ট্রানজিট কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে। ২০১৪ সালে ২১-২৩ এপ্রিল দুই দেশের রেলওয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে আন্তঃদেশীয় রেলওয়ে বৈঠকে রুটটি পুনরায় চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে সৈয়দপুর থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বুড়িমারী-চেংড়াবান্ধা রুট : বাংলাদেশের বুড়িমারী থেকে ভারতের চেংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রেলপথটি ১৯৭১ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। এই রেলপথটি ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট কার্যক্রমের একটি সম্ভাব্য রুট হতে পারে। এই রেলপথটি নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
আখাউড়া-আগরতলা রুট : বাংলাদেশের আখাউড়া থেকে ভারতের আগরতলা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশে ১০ কিলোমিটার এবং ভারতের অংশে ৫ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যৌথভাবে এই রেলপথটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
ফেনী-বিলোনিয়া : বাংলাদেশের ফেনী থেকে ভারতের বিলোনিয়া পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতের রাজ্য ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এ রেললাইন ব্যবহৃত হবে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এ রেললাইনের সংস্কারে যাবতীয় ব্যয় বহন করবে ভারত সরকার। আসামের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৯২৯ সালে এ রেলপথ চালু করে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি। প্রথমদিকে এ লাইনে মালবাহী ট্রেন চলাচল করলেও ১৯৪৭ সালের পরে রেলপথটি বন্ধ হয়ে যায়।