নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী, একাধিক বর্তমান ও সাবেক সাংসদ, তাঁদের স্বজন, দলের নেতাসহ ৪৪ জন এবার সরকারি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। রাজউকের পূর্বাচল, ঝিলমিল ও উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে সংরক্ষিত কোটায় সম্প্রতি এই প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। তালিকায় রাজউকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছাড়াও ওই প্রতিষ্ঠানের দুজন কর্মকর্তা, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের পাঁচ কর্মকর্তা এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাত কর্মকর্তা আছেন। আছেন ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাও। এর আগে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে সাংসদ, তাদের আত্মীয় ও আমলাসহ ৩৪ জনকে বিশেষ কোটায় তিনটি প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংরক্ষিত কোটায় কারা প্লট পেতে পারেন, সেই মানদণ্ডের কথা বলা আছে রাজউকের বরাদ্দ নীতিমালার ১৩-এ ধারায়। এতে বলা আছে—সাংসদ, বিচারপতি, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, যাঁরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রেখেছেন, তাঁদের প্লট দেওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বরাদ্দ পাওয়া ৪৪ জনের বেশির ভাগই এই মানদণ্ড পূরণ করেন না। তাঁরা প্লট পেয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। রাজউকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (উন্নয়ন) মো. আবদুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো হাত নেই।মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাইয়ের পর আমাদের কাছে একটা তালিকা পাঠানো হয়। আমরা সেটা অনুমোদন করি মাত্র।’ তিনি নিজেই এবার পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠার একটা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অবদানের কোন কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘প্রশ্নটা আমাকে না করে সরকারকে করতে হবে। এখানে রাজউকের কোনো ভূমিকা নেই। সরকারই এটা নির্ধারণ করে।’ যাঁদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁদের বিশেষ অবদানের বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি যদি মনে করি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁদের অবদান আছে, তাহলে কী করার আছে? ১৩-এ ধারায় সরকার যদি মনে করে অবদান আছে, তাহলে অবদান না থাকলেও আছে।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ মোবাশ্বের হোসেন বলেন, সরকার এটা মনে করতে পারে না। সরকার বড়জোর রাষ্ট্রীয় অবদানের সূচকগুলো নির্ধারণ করে দিতে পারে। সমাজের বিশিষ্টজনদের নিয়ে গঠিত একটি স্বাধীন কমিটির মাধ্যমে বরাদ্দ তালিকা তৈরি হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। প্লট নেই, প্লট আছে প্লট বরাদ্দের জন্য গত ১৩ মার্চ পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে ২৮ জনের তালিকাসহ একটি চিঠি রাজউকে পাঠানো হয়। চিঠিতে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে একজন প্রতিমন্ত্রী, একজন সাংসদ, দলের তিন নেতা, তাঁদের স্বজনসহ মোট ১১ ব্যক্তিকে ১০টি প্লট বরাদ্দের নির্দেশনা ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক দুই দফায় মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানায়, পূর্বাচল প্রকল্পে সংরক্ষিত কোটায় বরাদ্দযোগ্য আর কোনো প্লট অবশিষ্ট নেই। তা সত্ত্বেও রাজউকের ২৯ মার্চের বোর্ড সভায় ওই ১১ ব্যক্তিকে ১০টি প্লট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে ১০ কাঠার চারটি প্লট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ শামীম ওসমান, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমানের ভাই যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র নাসায় কর্মরত জাহিদুল এইচ এম রহমান ও আবু নাসের মো. জহির নামের একজন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না পেয়েছেন সাড়ে সাত কাঠার একটি প্লট। রাষ্ট্রীয় কাজে পান্নার অবদানের বিষয়ে জানতে চাইলে পূর্তমন্ত্রী বলেন, ‘পান্না কি আন্দোলন করেনি? এর আগে মান্নান (সাবেক পূর্তমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান) ওরে প্লট না দিয়ে ভুল করেছে। এইটা আমার দায়িত্ব, ওকে প্লট দেওয়া।’ এ ছাড়া একই প্রকল্পে আওয়ামী লীগের অস্ট্রেলিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রদ্যুত সিং চুন্নু ও কোষাধ্যক্ষ মো. রতন খান দুজন মিলে পাঁচ কাঠার একটি প্লট পেয়েছেন। বাকি তিনটি পাঁচ কাঠার প্লট পেয়েছেন কানাডাপ্রবাসী নাসিমুল হক চৌধুরী, রাজউকের সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও বর্তমানে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান মুন্সী এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) রহমত উল্লাহ মো. দস্তগীর। ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের (ডিআইটি) সাবেক ট্রাস্টি সদস্য ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খানের মতে, সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ নীতিমালা না থাকার কারণেই এমন অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি ঘটছে। সঠিকভাবে বিচার করলে তাঁদের অধিকাংশই এই কোটায় প্লট পান না। হাফিজউদ্দিন খান বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ দিতে গিয়ে বাধ্য হয়ে প্রকল্পের নকশা কিংবা শ্রেণি পরিবর্তন করতে হয়। তখন প্রকল্প থেকে খেলার মাঠ কিংবা উন্মুক্ত জায়গাগুলো বাদ পড়ে। আরও যাঁরা প্লট পেলেন: ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত রাজউকের বোর্ড সভায় মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তালিকা অনুসারে মোট ২৮ জনকে প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে পূর্বাচলে ১০টি প্লটের বাইরে উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২ নমিতা হালদার পাঁচ কাঠা ও সাবেক সাংসদ মির্জা তোফাজ্জল হোসেন চার কাঠার দুটি প্লট পেয়েছেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব মো. নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম মুশফিক, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মকবুল হোসেন ও কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ব্যারিস্টার বাদল রশীদের স্ত্রী বেগম শরীফা রশীদ তিন কাঠা করে প্লট পেয়েছেন। ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে সাংসদ টিপু মুন্সী, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আখতার হোসেন এবং রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) মো. আকতার উজ জামান পেয়েছেন পাঁচ কাঠার তিনটি প্লট। এ ছাড়া তিন কাঠার প্লট পেয়েছেন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কে বি এম মফিজুর রহমান খান, পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. শাহাদাৎ হোসেন এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শ্যামলী নবী। এর আগে গত বছরের ২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো তালিকা অনুসারে মোট ১৬ জনকে তিনটি আবাসিক প্রকল্পে প্লট প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাই কেনিয়াপ্রবাসী চিকিৎসক ডা. মাহাবুবুর রহমান খান ১০ কাঠা, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল মো. সাহেদুল ইসলাম এবং রাজউকের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (উন্নয়ন) আবদুর রহমানকে সাড়ে সাত কাঠার দুটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই প্রকল্পে পাঁচ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পিপিপি সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আফসার এইচ উদ্দীন। ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে পাঁচ কাঠার প্লট বরাদ্দ পান বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য সেলিম মাহমুদ, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী ও রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) দুলাল কৃষ্ণ সাহা। ওই সভায় উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে তিন কাঠার পাঁচটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট কর্মকর্তা গাজী হাফিজুর রহমান, সাবেক অ্যাসাইনমেন্ট কর্মকর্তা মরহুম মো. রাকিব হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা ইয়াসমিন, অ্যাডভোকেট সফিকুল আলম (১/২, রাজার দেউরি, ঢাকা), গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (সচিবের একান্ত সচিব) মো. আল মামুন ও গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আ. বাতেন মিয়া। – See more at: http://www.deshebideshe.com/news/details/79892#sthash.elBLVHyF.dpuf