Monday , 23 December 2024
নিউজ টপ লাইন
এবার ঢাকায় জাল দলিলে রাগীব আলীর ৭০ কোটি টাকার জমি বিক্রি

এবার ঢাকায় জাল দলিলে রাগীব আলীর ৭০ কোটি টাকার জমি বিক্রি

নিজস্ব প্রতিবেদক: এবার জাল দলিল দিয়ে গুলশানের ২২ কাঠারও বেশি জমি বিক্রি করেছেন আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী রাগীব আলী। আর মূল্যবান এই সম্পত্তিটি কিনেছেন এ সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদার। অথচ জমিটি অগ্রণী ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেওয়া।

আবার রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক এখন নজরুল ইসলাম মজুমদারকে জমি পাইয়ে দিতে নানা ধরনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশও চাইছে গুলশানের এই দামি সম্পত্তি নজরুল ইসলাম মজুমদারেরই হোক। যদিও সর্বোচ্চ আদালত থেকে বলা হয়েছে জমির দলিলটাই জাল। দলিল জাল করেছেন সিলেটের কথিত দানবীর রাগীব আলী। ব্যাংকের সহায়তায় অন্যের বন্ধকি জমি কেনাবেচা করার এই ঘটনা ব্যাংকিং ইতিহাসে বিরল বলেই জানাচ্ছেন ব্যাংকাররা।

নজরুল ইসলাম মজুমদার বেসরকারি ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে তিনি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসেরও (বিএবি) চেয়ারম্যান। সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলেই ব্যবসায়ী মহলে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। ব্যাংক ব্যবসা ছাড়াও তিনি একজন তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী।

অন্যদিকে ভুয়া দলিল দিয়ে জমি বিক্রি করা রাগীব আলী বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান। রাগীব আলী যে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সম্পত্তি দখল করে থাকেন, সুপ্রিম কোর্টের অন্য এক রায়েও তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ একটি বেঞ্চ গত ১৯ জানুয়ারি এক রায়ে বলেছেন, নিজের নামে চা-বাগানের সম্পত্তি ইজারা দেখাতে রাগীব আলী ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শাহ ইমদাদুল হকের স্বাক্ষর জাল করে প্রায় এক যুগ সিলেটের তারাপুর চা-বাগান (দেবোত্তর সম্পত্তি) দখলে রাখেন।

গুলশানের মূল্যবান ২২ কাঠা ২ ছটাক জমির মূল মালিক এ আর এ জুট ট্রেডিং করপোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানটির নেওয়া ঋণের বিপরীতেই অগ্রণী ব্যাংকের কাছে জমিটি বন্ধক রয়েছে। আর এ অবস্থাতেই জাল দলিল দিয়ে ওই সম্পত্তি বেচাকেনা করেছেন প্রভাবশালী ওই দুই ব্যবসায়ী। অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক, সুপ্রিম কোর্ট এবং অগ্রণী ব্যাংক থেকে পাওয়া বিভিন্ন চিঠি ও স্মারকলিপি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে চেষ্টা করেও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখতের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

যেভাবে শুরু: অগ্রণী ব্যাংকের পর্ষদ বৈঠকে উপস্থাপিত নথি অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ কোর্ট রোড শাখা থেকে ২৬ বছর আগে, ১৯৯০ সালে ৫ কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল এ আর এ জুট ট্রেডিং। ঋণের বিপরীতে বন্ধক ছিল গুলশানের ১ বিঘা ২ কাঠা ২ ছটাক জমিসহ রাজধানীর তেজতুরীবাজারের ৫ কাঠা ও সেনপাড়া পর্বতার ১০ কাঠা ১৩ ছটাক জমি এবং খুলনার দৌলতপুরের একটি ফ্ল্যাট।

কিন্তু ৭২ লাখ টাকা পরিশোধের পর খেলাপি হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর সুদাসলে ১৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা আদায়ে ১৯৯৭ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে অগ্রণী ব্যাংক। রায় পক্ষে এলে ২০০১ সালে গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যাংক ডিক্রি জারি মামলা করে। এবার ব্যাংকের দাবি ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সর্বশেষ ব্যাংকের দাবি বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে আদালতের সিদ্ধান্তে গত বছর, ২০১৫ সালে ৪০ কোটি ৩২ লাখ টাকা মওকুফ পায় এ আর এ জুট ট্রেডিং। ফলে প্রতিষ্ঠানটির চূড়ান্ত দেনা দাঁড়ায় ১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

সব সম্পত্তি অবমুক্ত করতে অগ্রণী ব্যাংককে ১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে- আদালত এমন রায় দেওয়ার পর এ আর এ জুট ট্রেডিং টাকা জমা দিতে ব্যাংকে যায়। ব্যাংক তখন প্রতিষ্ঠানটিকে জানায়, টাকা দিতে হবে না, বরং নজরুল ইসলাম মজুমদারের নামে গুলশানের জমিটি লিখে দিতে হবে।

কেন নজরুল ইসলাম মজুমদার: এ আর এ জুট ট্রেডিংয়ের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক না থাকলেও পুরো ঘটনায় নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রবেশ করেন ২০১২ সালে। এ নিয়ে ব্যাংকের নথিতে লেখা আছে, নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে রাগীব আলী নিজের জমি দেখিয়ে তা বিক্রি করেন ২০১২ সালের ২২ মে। অথচ ২০০৪ সাল থেকেই রাগীব আলীর বিরুদ্ধে জমির মালিকানা নিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের মামলা চলমান। তবে মামলা চলাকালে জমি কেনাবেচা কীভাবে করা হলো এর কোনো সদুত্তর ব্যাংকও দিতে পারেনি।

নথিপত্র অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংকের করা মামলায় জজকোর্টের পর হাইকোর্টের রায়ও যায় রাগীব আলীর বিরুদ্ধে। তারপরও তিনি জমি বিক্রি করেন নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে। বিক্রির পর রাগীব আলী আপিল করেন সুপ্রিম কোর্টে। ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টেও রাগীব আলীর দলিল বাতিল হয়। এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে পুনঃশুনানি হলে সেখানেও হেরে যান তিনি।

যোগাযোগ করলে কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী তানজীব-উল-আলম বলেন, ‘ঘটনা হচ্ছে ব্যাংকের সঙ্গে এ আর এ জুট ট্রেডিংয়ের। নজরুল ইসলাম মজুমদার এখানে কিছুই নয়।’ তিনি বলেন, ‘আদালতে যেহেতু রাগীব আলীর দলিল টেকেনি, খুবই স্বাভাবিক যে নজরুল ইসলাম মজুমদারের দলিলও অবৈধ হবে।’

নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘আমি রাগীব আলীর কাছ থেকে জমি কিনেছি ৭০ কোটি টাকায়। ৬০ কোটি টাকায় দলিল হয়, ১০ কোটি টাকা দিয়েছি নগদ। জমিটি যেহেতু ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ, সেটা পরিষ্কার করতেই ব্যাংককে টাকা দিয়েছি।’

অগ্রণী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি কাজী সানাউল হক বলেন, ‘নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পর এ আর এ জুটের কাছ থেকেও টাকা নেওয়া হয়েছে। কেন নেওয়া হয়েছে, সে ব্যাখ্যা আমি এখন দিতে পারব না।’

রাগীব আলী কীভাবে এখানে: পুরো ঘটনায় রাগীব আলীর প্রবেশও হঠাৎ করে। এ নিয়ে গত ২২ ডিসেম্বরের পর্ষদ বৈঠকের পর ২৩ ডিসেম্বর তৈরি অগ্রণী ব্যাংকের এক স্মারকে বলা হয়, ২০০৪ সালে ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকায় গুলশানের জমিটি বিক্রির জন্য রাগীব আলীর সঙ্গে চুক্তি করে এ আর এ জুট ট্রেডিং। অগ্রণী ব্যাংক তখন রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই মামলায় শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টেও হেরে যান রাগীব আলী, বাতিল হয় জমির দলিল।

রাগীব আলীর দলিল তো বাতিল হয়ে গেছে, আপনার দলিল কীভাবে বৈধ হয়, এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘আমি কাগজপত্র দেখেই কিনেছি। মাঝখানে যে ব্যাংক মামলা করে রেখেছে, তা রাগীব আলী আমার কাছে গোপন করেছেন।’

সব আদালতে আপনার দলিল বাতিল হয়ে গেছে, নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে জমি বিক্রি তো তাহলে অবৈধ, জানতে চাইলে রাগীব বলেন, ‘কাগজপত্র না দেখে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে বিক্রির পর আদালতে মোকদ্দমার সব বিষয় নজরুল ইসলাম মজুমদারের দেখার কথা।’ এ বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য নেই বলেও জানান রাগীব আলী।

আইনজীবী তানজীব-উল-আলম সামগ্রিক বিষয়ে বলেন, ‘আমার মনে হয় এই ঘটনায় অগ্রণী ব্যাংক, রাগীব আলী ও নজরুল ইসলাম মজুমদার- সবারই ভুল রয়েছে। তবে প্রতারণা করায় রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। আর অগ্রণী ব্যাংকের উচিত হবে এ আর এ জুটের কাছ থেকে টাকা নেওয়া।’

About admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

সর্বশেষ নিউজ

ফেসবুক পেইজ The Daily Neighbour

ডেইলি নেইবার আর্কাইভ

August 2016
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
Scroll To Top