নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের জন্য বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ, দুই জোটের বাইরে থাকা দলগুলোর শর্ত, সর্বোপরি দলের মধ্যেই জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের চাপের মুখে দাঁড়িয়ে লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে তিনি যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন সেখানে জামায়াতকে ছেড়ে জাতীয় ঐক্য গড়বেন, নাকি শেষ পর্যন্ত জামায়াতকেই পাশে রাখবেন- সেই সিদ্ধান্ত দেখার অপেক্ষায় রাজনৈতিক অঙ্গন। এরই মধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছেন তিনি। বিএনপি কোন পথে হাঁটবে তা নির্ভর করছে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের ওপর। তবে রাজনীতির এই মেরুকরণে দাঁড়িয়ে বিএনপি বেশ চাপেই আছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে জামায়াত ছাড়ার শর্তে বিএনপি চাপেই আছে বলে মনে হচ্ছে। তবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল অনৈতিক রাজনীতি করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো আঁতাতের রাজনীতির অনৈতিক খেলা খেলছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে এর সমাধান করা জরুরি।’
সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না কেন, সে প্রশ্নও তোলেন বদিউর আলম মজুমদার।
তবে জাতীয় ঐক্য গড়তে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার ব্যাপারে অন্য দলগুলোর শর্তে বিএনপি চাপে নেই বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শুক্রবার রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে যেসব শর্তের কথা বলা হচ্ছে, তাতে বিএনপি চাপে নেই। জাতীয় ঐক্য নিয়ে সবেমাত্র বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সব দলের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছেন। তিনি সবার মতামত নেবেন, আলোচনা করবেন; পরে একটি সিদ্ধান্ত হবে।’
বিএনপি জাতীয় স্বার্থেই জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন বলেও জানান দলটির মহাসচিব।
দলীয় সূত্র বলছে, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয়ে আগে থেকেই দলের মধ্যে বিরোধিতাকারী একটি অংশ বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছেন যে, এতে বিএনপির লাভ কী? তবে তারা শক্ত অবস্থান নিতে পারেননি। কিন্তু এবার জাতীয় ঐক্য ইস্যুতে সব পর্যায় থেকে জামায়াত ছাড়ার রব উঠলে তাদের দাবি আরো জোরালো হচ্ছে। সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিভিন্ন পরামর্শকও আকারে-ইঙ্গিতে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের কথা বলার বিষয়টিকে দলের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তারা।
বিএনপি নেত্রীর পরামর্শক হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দল বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ২০ দলের মধ্যে জামায়াতকে আর ওইভাবে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি বুঝতে পেরেছেন, ওই দলটিকে রাখলে যে লায়াবিলিটি (দায়বদ্ধতা) আসে সেটা তিনি বহন করতে চান না। সুতরাং এই দিক থেকে দেখলে জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা নেই।’
যদিও এমাজউদ্দীনের ওই বক্তব্যের পর জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া আসে। বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি ওই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে জামায়াত নেতারা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কচ্ছেদ নিয়ে এমাজউদ্দীন আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তার ‘ব্যক্তিগত মত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘জামায়াত নিয়ে এমাজউদ্দিন আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তার ব্যক্তিগত মতামত। তা ছাড়া তিনি ওই বক্তব্যের পর এই বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে বিবৃতিও দিয়েছেন।’
এদিকে বিএনপির জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু করেছেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
বৃহস্পতিবার রাতে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তিনি। বৈঠকে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তার স্ত্রী ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নাসরিন সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী ও শফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে খালেদা জিয়াকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের শর্ত দিয়েছেন দলটির নেতা কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকলে কাদের সিদ্দিকী থাকবেন না। যদিও তার ওই কথার পর খালেদা জিয়া কোনো মন্তব্য করেননি। তবে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে দলটির প্রধান কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ১০ মিনিট একান্তে বৈঠকও করেন খালেদা জিয়া।
শুক্রবার ওই বৈঠকের বিষয় নিয়ে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘সার্বিকভাবে জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার, সেখানে জামায়াত থাকবে না। তেমনি বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতের জন্য দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য দায়ী গণবাহিনীও সেখানে থাকবে না।’
খালেদা জিয়ার সাথে ‘দীর্ঘ’ আলোচনায় তাকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পাওয়া এই রাজনীতিক। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে বলেছি, বঙ্গবন্ধু ছাড়া রাজনীতি করব না, জামাতকে নিয়ে রাজনীতি করব না। খালেদা জিয়াকে জাতীয় নেতৃত্ব দিতে হলে প্রথমে স্পষ্টভাবে বলতে হবে যে, জামায়াত তার জোটে নেই।’
সূত্রগুলো বলছে, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মাধ্যমে দুই জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হলো। এরই ধারাবাহিকতায় গণফোরাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) এবং কয়েকটি বাম সংগঠনের সঙ্গেও বৈঠক করবেন বিএনপি নেত্রী। তবে এসব দলের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য তখনই হতে পারে, যখন বিএনপি জামায়াত ছাড়বে- এমন শর্ত দিয়ে রেখেছেন তারা।
বিএনপির একাধিক সূত্রের দাবি, দলটির বড় একটি অংশ চাচ্ছে ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত বড় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হলেও বৃহত্তর স্বার্থে এখন দলটির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের সময় এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতিও সেটিই দাবি করে। তাদের যুক্তি, জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে বিএনপি দীর্ঘদিন পর রাজনীতির মাঠে ইউটার্ন করার সুযোগ পেয়েছে। তা ছাড়া যেসব রাজনৈতিক দল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল, তাদেরও একই প্লাটফর্মে আনতে জাতীয় ঐক্য একটি সুযোগ। আর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট রাজনৈতিক এবং আন্দোলনের। তবে দলের আরেকটি অংশ জামায়াতকে দূরে ঠেলে দেওয়ার বিপক্ষে। তাদের মতে, জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে দিলে ঐক্য ফলপ্রসূ হবে কি না? তা ছাড়া দুই জোটের বাইরে থাকা দলগুলো বৃহত্তর প্লাটফর্মে আসবে কিনা- সেটিও এক প্রশ্ন। তারা মনে করছেন, সব বিষয় চূড়ান্ত হলেই কেবল জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত চান তারা।
এদিকে জামায়াত নিয়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে পরামর্শ এবং শর্তের বেড়াজালে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জটিল সমীকরণে পড়েছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। তবে দলীয় সূত্র বলছে, হুট করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না তিনি। যেহেতু জাতীয় ঐক্য একটি প্রক্রিয়া এবং একটি দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তা শুরু হয়েছে, সুতরাং তিনি ২০ দলীয় জোটের শরিক, জোটের বাইরের রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকার জামায়াত ইসলামীকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপিকে চাপে রাখতে চায়।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকার তার অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে জঙ্গিবাদ আর জামায়াত ইসলামীকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করছে।
আমির খসরু আরো বলেন, ‘আজকে জঙ্গিবাদের কথা বলা হচ্ছে, এটাও একটা রাজনীতি। ক্ষমতাসীনরা অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে, সেটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতেই জঙ্গিবাদকে রাজনীতির মূলধন হিসেবে ব্যবহার করছে। জঙ্গিবাদের মতো জামায়াতে ইসলামীও সরকারের আর একটি মূলধন। সরকার নিজের মতো করে জামায়াত ইস্যুকে ঢুকিয়ে রাখে, আবার বের করে। আমি সরকারকে বলব, জামায়াতকে মূলধন করে বেশি দিন চলা যাবে না।’
ভয় থেকে সরকার জাতীয় ঐক্য চায় না, এ মন্তব্য করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, জঙ্গিবাদের যে সংকট তৈরি হয়েছে, সরকারকেই এই সংকটের সমাধান করতে হবে। শুধু অস্ত্র দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করা যাবে না। এজন্য পাল্টা দর্শন দরকার। সেজন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য ছাড়া এককভাবে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করা বা এই সংকটের সমাধান করা সম্ভব নয়।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফেরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নাম ব্যবহার করছে। সরকার জাতীয় ঐক্যে জামায়াতকে রাজনেতিক কার্ড হিসেবে খেলছে।