নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার বজায় রাখার জন্য ‘উত্তরাধিকার আইন’ প্রণয়ন করবে। যে আইনে হিন্দু সম্পত্তির উত্তরাধিকারীগণ তাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি গ্রহণ করতে কোনো প্রকার ট্যাক্স প্রদান করতে হবে না।
সোমবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি বাসভবন গণভবনে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের যেটা বড় সমস্যা তা হলো আপনাদের কোনো উত্তরাধিকার আইন নাই, সূত্র নাই- এটাতো ঠিক, একজন মারা গেলে তার স্ত্রী সম্পদের উত্তরাধিকার পাবে না বা ছেলে-মেয়ে পাবে না, সে অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াবে। সম্পত্তি থাকতেও ভোগ করতে পারবে না, জীবন চালাতে পারবে না, এটা হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘এখন আপনারা যদি একতাবদ্ধ হয়ে এই উত্তরাধিকার আইন করতে চান, আপনারাই মিলিতভাবে আইনটা করে দেবেন, যেহেতু আপনাদের ধর্ম। আমরা এটা পাশ করে দেব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা আপনাদেরকেই করতে হবে।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বিরেন সিকদার, মৎস ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র, ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ধ্রুবেসানন্দ মহারাজ, চট্টগ্রাম ঋষিধাম আশ্রমের প্রধান সুদর্শনানন্দ মহারাজ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটি, জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি নেতৃবৃন্দের মধ্যে জয়ন্ত সেন দিপু, দেবাশিষ পালিত, রমেশ ঘোষ, ডিএন চ্যাটার্জী, চন্দন বিশ্বাস, তাপস কুমার পালও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পচাত্তরের ১৫ আগস্টে শহীদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবার পরিজনদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
শেখ হাসিনা হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন আপনাদের অনেক কিছুই চাইতে হয়নি। আমরা যেটা প্রযোজন মনে করেছি তা সাথে সাথে করে দিয়েছি। আমরা যখন ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট করলাম সাথে সাথেই হিন্দু-বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের জন্য সেই কল্যাণ ট্রাস্ট করে দিয়েছি। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দের বিধান রেখে আজ এ সম্পর্কিত তিনটি আইনের খসড়া মন্ত্রীসভা অনুমোদন দিয়েছে। যেটা পার্লামেন্টে পাশ হবে। এভাবেই সকলের কল্যাণেই এই সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী পূজার সময় বিদেশ থেকে রাধা কৃষ্ণের মার্বেলের মুর্তি আমদানি শুল্কমুক্ত করার বিষয়ে অনুষ্ঠানে দাবির প্রেক্ষিতে বলেন, এটা ঢালাওভাবেতো আমদানীর কোন প্রয়োজন নাই। কিন্তু যখন যার আমদানীর প্রয়োজন হবে, সে এনবিআর’র (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) কাছে লিখিতভাবে আবেদন করলে তাকে অনুমতি দেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপার। যারাই যখন রাধাকৃষ্ণ মূর্তি আনতে চান, যদি একত্রে অনেকেই আনতে চান তারা এনবিআর’র কাছে আবেদন করলে তাদের ট্যাক্স রিবেট দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি থাইল্যান্ড থেকে ২ শ’ বৌদ্ধ মূর্তি আনার বিষয়ে সরকার অনুমোদন দিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমি সব সময় এটা বিশ্বাস করি- সকল ধর্ম, বর্ণ নির্বেশেষে সকলেরই এই মাটিতে বসবাস করার অধিকার রয়েছে এবং সকলে সেই অধিকার নিয়েই এখানে বসবাস করবেন- এটাই আমরা চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ধর্মটা যার যার কিন্তু উৎসবটা সবার, আমি বলব এই চেতনা বাংলাদেশীদের মধ্যে রয়েছে। তিনি একে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য আখ্যায়িত করে পৃথিবীর মধ্যে অনন্য নজির বলেও উল্লেখ করেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাঝে মাঝে দেশে কিছু ঘটনা ঘটে বা সুপরিকল্পিতভাবে কিছু ঘটনা ঘটানো হয়- দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ সহনশীল। কিছুদিন আগে যে ঘটনা ঘটল, একটার পর একটা (জঙ্গি হামলা)। আমরা মানুষকে আহবান করলাম, আপনারা নিজেরাই লক্ষ্য করেছেন- বাংলাদেশের মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ, তারা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ চায় না। সবাই শান্তি চায়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আর সেই শান্তির জন্য আজ সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চেতনাবদ্ধ হয়ে চলছে। এই চেতনাটাই তাদের শক্তি।’
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সন্ত্রাস আজ শুধু বাংলাদেশে না সমগ্র বিশ্বেরই একটা সমস্যা। আমেরিকার মত সেক্যুলার দেশে মসজিদের ইমাম, মুসল্লি থেকে শুরু করে, একের পর এক বাঙালি হত্যা, সন্ত্রাসী ঘটনা লেগেই আছে, সমগ্র বিশ্বজুড়েই একটা অশান্তি লেগে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমরা মানুষকে যখন শান্তির জন্য একতাবদ্ধ হবার আহবান করলাম, তখন মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া লক্ষ্য করা গেছে। এখন সকল মানুষ সচেতন। শুধু তাই নয়, আমাদের ইসলাম ধর্মে যে শান্তির বাণী রয়েছে সেটা সকলে মিলেই প্রচার করছে। সেভাবে আমি চাই-আপনাদের হিন্দু সম্প্রদায়ও আপনাদের ধর্মে যে শান্তির বানী বলা আছে সেটাও যেন ব্যাপকভাবে প্রচার করেন। সেভাবেই খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ সকল ধর্মবাবলম্বীদেরকেও আমি এই অনুরোধ জানাব- তারাও যেন তাদের ধর্মের শান্তির বানী প্রচার করেন। কারণ সকল ধর্মেই শান্তির কথা বলা হয়েছে।’
শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মানুষে মানুষে ভাতৃত্ববোধ যেন গড়ে ওঠে সেই প্রত্যাশা করে যার যার ধর্ম সে সে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘যে যে ধর্মেরই হোক না কেন, এদেশের প্রত্যেকটি মানুষের একে অন্যের জন্য সহানুভূতি থাকবে, সহমর্মিতা থাকবে।’
শেখ হাসিনা বাংলার মুক্তিসংগ্রামের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘এই সে মহান দেশ, যে দেশের মুক্তির সংগ্রামে সকল ধর্মের মানুষ রক্ত দিয়েছে। সকল শহীদের রক্ত কিন্তু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সেই দেশের মাটিতে সবাই সবার অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। মানবতার জয় যেন সব সময় হয় সেটাই আমরা প্রত্যাশা করি।’
তিনি এ সময় ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তি সংখ্যালঘু হামলাসহ বিভিন্ন সময়ে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত সন্ত্রাস-নির্যাতনের কঠোর সমালোচনা করে সন্ত্রাসীর কোন ধর্ম, জাতি মনুষত্ব নেই উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তারা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর যেমন হামলা করেছে, আওয়ামী লীগ করার অপরাধে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে। তেমনি মসজিদে আবার কোরআন শরিফ পর্যন্ত পুড়িয়েছে। এগুলো আর কোনো দিন যেন বাংলার মাটিতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য সকলের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন সমগ্র জাতির মাঝেই একটা চেতনার উন্মেষ ঘটেছে, আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছি সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। কাজেই আমাদের এই চেতনা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। আমরা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সকলকে নিয়েই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবো।’