নিজস্ব প্রতিবেদক :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছে অ্যানেসথেশিয়া বিষয়টি সর্বাধিক গুরত্ব পেলেও বাংলাদেশে অ্যানেসথেসিয়া বিষয়টি চরম অবহেলিত। বর্তমান প্রজন্মের চিকিৎসকদের কেউ ভুলেও এ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে রাজি হয় না। একজন রোগীর সফল অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্টের ভূমিকা খুবই গুরত্বপূর্ণ হলেও পর্দার অন্তরালে থাকায় তাদের প্রচার প্রচারণা নেই। বিভিন্ন সরকারের আমলে দেশে অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সংকটের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা হলেও সমস্যা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে সর্বসাকুল্যে অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সংখ্যা দেড় হাজারেরও কম। জনসংখ্যা অনুপাতে হিসেব করলে প্রতি এক লাখেরও বেশি জনসংখ্যার জন্য মাত্র ১ জন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট আছেন। বর্তমানে সারাদেশে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্নাতকোত্তর ইন্সিটিটিউট, বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলাসহ মোট হাসপাতালের সংখ্যা প্রায় ৬শ। সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে অধ্যাপকের পদ রয়েছে মাত্র ১১টি। বর্তমানে অধ্যাপকের ৬টি পদই শূন্য রয়েছে।
এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এর উদ্যোগে আজ ১৭০তম বিশ্ব অ্যানেসথেসিয়া দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আপনার অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে জানুন’।
গুরত্বপূর্ণ এ বিষয়টিতে কেন চিকিৎসকরা আসতে আগ্রহী হচ্ছে না এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এর একাধিক চিকিৎসক জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাধীনতাত্তোরকালে সার্জারি বিভাগে অধ্যাপকের পদ ছিল ৩টি। একই সময় অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে অধ্যাপকের পদ ছিল ১টি। পরবর্তী ৪৫ বছরে সার্জারি বিভাগে বিশেষায়িত শাখা খোলা হয়েছে। বর্তমানে সার্জারির বিভিন্ন শাখায় কর্মরত অধ্যাপকের সংখ্যা ৩০ জনের বেশি। কিন্তু অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে অধ্যাপকের সেই ১টি পদই রয়ে গেছে।
শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের আমলেই নিউরোসায়েন্স ইন্সিটিটিউট ও ইএনটি ইন্সিটিটিটসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতাল খোলা হলেও ওই সব হাসপাতালে অ্যানেসথেসিয়ার অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। জুনিয়র চিকিৎসকরা যখন দেখে অ্যানেসথেসিয়ার বয়োজেষ্ঠ্য চিকিৎসকরা পদোন্নতি না পেয়ে চাকরি জীবন শেষ করছেন তখন তারা এ বিষয়ে আসতে আগ্রহী হয় না।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এর সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. আবদুর রহমান বলেন, যতদিন পর্যন্ত সার্জারির বিভিন্ন বিষয় খোলার সময় অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ে অধ্যাপকসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য পদ খোলা না হবে ততদিন পর্যন্ত অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ের প্রতি জুনিয়র চিকিৎসকদের আগ্রহ তৈরি হবে না। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিশ্ব অ্যানেসথেসিওলজি দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এর উদ্যোগে শনিবার বিএসএমএমইউতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ হাসান বলেন, অ্যানেসথেসিওলজিস্টের স্বল্পতার বিষয়ে অন্যান্য সার্জিক্যাল ফ্যাকাল্টি যেমন জেনারেল সার্জারি, অর্থপেডিক, নিউরো, ইএনটি, শিশু সার্জারি ইত্যাদির ডাক্তারের সমানুপাতিক হারে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এর পোস্ট না থাকায় এই ধরনের স্বল্পতা সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা মুমূর্ষু রোগীর সেবা (ইনটেনসিভ কেয়ার), ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল ব্যাথার চিকিৎসা এবং জরুরি জীবন রক্ষাকারী (সিপিআর) চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকতে হয়। যার কারণে আরো অ্যানেসথেসিওলজিস্টের প্রয়োজন যা সম্মিলিত উদ্যোগে স্বল্পতা পূরণ করা সম্ভব বলে বক্তরা অভিমত ব্যক্ত করেন।
সিনিয়র বিশেষজ্ঞ অ্যানেসথেসিওলজিস্ট অধ্যাপক এম খলিলুর রহমান বলেন, নিরাপদ অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করার জন্য দক্ষ ও আধুনিক জ্ঞান সম্পন্ন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মানসম্পন্ন ওষুধ প্রয়োগ দরকার হয়। এর যে কোন একটির অভাব হলেই রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। এই ব্যাপারে বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, সার্জিক্যাল চিকিৎসক এবং সর্বপোরি রোগীকে সচেতন হতে হবে।
বক্তরা আরো উল্লেখ যে, অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ে রোগীকে জানাতে হবে এবং যেখানে অপারেশন হবে সেখানে অ্যানেসথেসিয়া চলাকালীন সময়ে মনিটরিং যন্ত্রপাতি আছে কিনা এই বিষয়েও সচেতন হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক সংকট সম্পর্কে তিনি অবহিত আছেন এবং এই সমস্যা সমাধানের জন্য অ্যানেসথেসিয়া সোসাইটি ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে বলে আশা করেন। অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ে ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের সংখ্যা ১৫০০ যা আগামী দুই বছরের মধ্যে দ্বিগুন বা তিনগুন হবে। এই বিষয়ে স্বাস্থ্য মহাপরিচালক একমত পোষণ করেন।