নিজস্ব প্রতিবেদক :
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় কুড়িগ্রামে ১০ টাকা মূল্যের চাল বিক্রির ডিলারশিপ নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
এ ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যাচাই বাচাই করার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী নিযুক্ত ডিলারের অধিকাংশেরই নেই খাদ্য সংরক্ষণের উপযোগী দোকান বা গুদাম ঘর।
রৌমারী উপজেলায় একই পরিবারের একাধিক সদস্যের নামে টিসিবি ও ওএমএম ডিলারশিপ খাকা সত্ত্বেও আরো একজনকে এই কর্মসূচির ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৫০০ জন কার্ডধারীর বিপরীতে একজন ডিলার হিসাবে ২৭ জনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা খাকলেও, নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১২ জনকে। যারা ডিলার নিয়োগ পেয়েছেন তারা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মী বলে অভিযোগ রয়েছে।
অপরদিকে হতদরিদ্রের নামে ১০ টাকা মূল্যের কার্ড প্রণয়নের কথা থাকলেও, স্বজনপ্রীতি ও দেরীতে চাল বিতরণ, চাল বিক্রিতে অনিয়ম, ওজনে কম, স্বচ্ছল ও প্রবাসীদের নামে চাল উত্তোলনসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।এ নিয়ে একাধিক অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
রৌমারীর ছয়টি ইউনিয়নে ১৪ হাজার ৫৯৪ জন হতদরিদ্রের নামে ১০ টাকা মূল্যের চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।সেপ্টেম্বর-থেকে নভেম্বর এবং আগামী বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে এই উপজেলায় ৪৩৭.৮২ মেট্রিক টন চাল বিক্রি হবে। একজন কার্ডধারী মাসে ৩০ কেজি চাল কিনতে পারবেন। বিধি অনুসারে সপ্তাহে তিনদিন শুক্র শনি ও মঙ্গলবার নির্দিষ্ট ডিলারের কাছ থেকে এই চাল সংগ্রহ করা যাবে। ডিলার কর্তৃক চাল বিতরণের সময় উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক মনোনীত ট্যাগ অফিসার উপস্থিত থাকবেন।
রৌমারীর সদর, শৌলমারী, দাঁতভাঙ্গা, বন্দবেড়, যাদুরচর ও চরশৌলমারী ইউনিয়নে ডিলারের কাছে চাল নিতে আসা লোকদের সঙ্গে আলাপে জানা যায় বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কথা।
সদর ইউনিয়নে দেখা গেছে, প্রবাসী মাহুজল (২৫৪৪০), মাহুবর (২৯৪৮), রফিকুর (২৯৭৫) ও হারুন (২৮৩১) কার্ড পেয়েছেন।
আর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে একই পরিবারে একাধিক কার্ড রয়েছে এমন ব্যক্তিরা হলেন আলী মোহামদ (২২২১), আব্দুস সবুর (২২১৯), জাহিদুল ইসলাম (৩৩০), আনজুমান আরা (৩৩৩), কামাল (৩৩৪) ও কমলা (৩৩৪)।
এ ছাড়া কার্ডধারী স্বচ্ছল ব্যক্তিরা হলেন আবুসাইদ (২৫৫৯), বাচ্চু মিয়া (২৭১৭), মুন্টু মিয়া ও খলিলুর রহমান।
অন্যদিকে ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের নির্বাচত মহিলা সদস্য শাহিদা খাতুন নিজেই নামে বেনামে সাতজনের তালিকা দিয়েছেন।
এদিকে চাল নিতে না আসার কারণে সদর ইউনিয়নে ২১৫টি কার্ডের চাল ফেরত দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
স্বচ্ছল ও বিত্তশালীদের কার্ড দেওয়া প্রসঙ্গে সদর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য মো. রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা কার্ডের জন্য গরীব মানুষের যে তালিকা দিয়েছি তার অর্ধেক নাম কেটে দিয়ে চেয়ারম্যান তার আত্মীয় স্বজনসহ স্বচ্ছল ও একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নাম দিয়েছেন। এখানে আমাদের করার কিছুই ছিল না।
সদর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য রবিউল করিম বলেন, আমার ওয়ার্ডে ৫৫০টি কার্ডের মধ্যে ২০০ জনের নাম দিয়েছি আমি। বাকি নাম চেয়ারম্যান দিয়েছেন। আমি যে নাম দিয়েছি তার মধ্যে দুই একজন স্বচ্ছল থাকতে পারে। আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলেছি এলাকায় মাইকিং করে নাম পরিবর্তন করে প্রকৃত গরীব লোকদের নাম দেওয়ার জন্য। কিন্তু চেয়ারম্যান আমাদের প্রস্তাবে এখনো রাজি হননি।
এ ব্যাপারে সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম শালু বলেন, আমরা যখন তালিকা করেছি তখন চালের দাম কম ছিল। গরীব মানুষরা বলেছে টাকা দিয়ে পচাঁ চাল খাবো কেন। এজন্য আমার ইউনিয়নে ২৯০০ কার্ডের চাহিদা মোতাবেক ধনী-গরীব মিলিয়ে নাম দিয়েছি।
অভিযোগের ব্যাপারে উপজেলার শৌলমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, আমাকে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে তালিকা দিয়েছে। সেখানে অনেক স্বচ্ছল ও বিত্তশালীর নাম ছিল। আমি তাদের নামে কার্ড দিতে না চাইলেও চাপের কারণে দিতে হয়েছে। আমার করার কিছুই ছিল না।
যাদুরচর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায, ডিলারের একটি দোকানে কিছু চালের বস্তা নিয়ে দুই ব্যক্তি বসে রয়েছেন। অপর এক ব্যক্তি বালতি দিয়ে চাল মেপে দিচ্ছেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, বালতি মাপা আছে কোনো সমস্যা নেই।
বন্দবের ইউনিয়নের ডিলার আব্দুল আলিম ও শৌলমারী ইউনিয়নের ডিলার জাবেদ আলীর কাছে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি টিনের ঘরে বসে চাল বিতরণ করছেন তারা। ভাল চালের সঙ্গে নিম্নমানের চাল মিশিয়ে সুবিধাভোগীদের দিচ্ছেন।
এদিকে গত ৯ অক্টোবর রৌমারীতে কর্মসূচির বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে মতবিনিময় সভায় রৌমারী উপজেলা যুব লীগের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ দাবি করেন, হতদরিদ্রদের বাদ দিয়ে ধনী, প্রভাবশালী ও প্রবাসী ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে চাল দেওয়া হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার আবদুল কাদের জানান, তালিকায় শতকরা ৮০ ভাগ ধনী ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং চেয়ারম্যানদের পছন্দের নামও বাদ পড়েনি।
রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউর ইসলাম মিনু বলেন, তালিকা দফায় দফায় পরিবর্তন করেছে চেয়ারম্যানরা। সরকারের ভাবমুর্তিক্ষুণ্ন করে যারা এসব অনিয়ম, দুনীতি ও স্বজনপ্রীতি করবে তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না।
১০টাকার চাল ২৮টাকায় ক্রয় করলেন ব্যবসায়ীরা, সে চাল বস্তাবন্দি হচ্ছে প্রকাশ্যে
প্রাক্তন এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, চাল নিয়ে চালবাজি চলবে না। এসব তালিকা পরিবর্তনসহ নতুনভাবে ডিলার নিয়োগ করতে হবে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য রুহুল আমিন বলেন, এসব অনিয়ম দুর্নীতি তদন্ত দল গঠনপূর্বক যাচাই বাছাই করা হবে। প্রয়োজনে এসব তালিকা পরির্বতনসহ নতুনভাবে ডিলার নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফিরোজ আহম্মদ মো. তফা বলেন, তালিকায় কোনো ধনী ব্যক্তির নাম দেওয়ার নিয়ম নেই। কোনো ধনী ব্যক্তির নাম পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে তালিকা সংশোধন ও নতুনভাবে ১৫জন ডিলারসহ নতুন ১৯০৯ কার্ড বরাদ্দ করার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া চাল নিতে না আসার কারণে ২১৫টি কার্ডের চাল ফেরত দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে রৌমারী উপজেলা নিবার্হী অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এ বিষয়ে আমি একাধিক মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ সত্য হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চেযারম্যানদের নিকট ইতিমধ্যে তালিকা সংশোধন ও নতুনভাবে কার্ড বরাদ্দের নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে।
এ দিকে চিলমারীতে ১০ টাকার চালের তালিকা প্রণয়নে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, কার্ডের বিনিময়ে টাকা নেওয়াসহ অভিযোগের পাল্লা দিনের পর দিন ভারী হয়েই চলছে। সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে হ য ব র ল অবস্থার।
এ ব্যাপারে কথা হয় উপজেলার পাত্রখাতা গ্রামের কানচোন বালার সঙ্গে। তিনি দুঃখের সঙ্গে বলেন, স্যার গো হামরা গরীব মানুষ, হামার কি আর উন্নতি হবে যামার আছে তামরাই পায়।
এ সময় এলাকার দিনমজুর মশিউরের স্ত্রী খাদিজা জানান, মহিলা মেম্বার (৭,৮ ও ৯) মোছা. জাহানারা এক হাজার টাকা চেয়েছিল রেশন কার্ড (১০টাকা কেজি কার্ড) দিবে বলে।
খাদিজা বলেন, ৫০০ টাকা লাভের ওপর আনি দিছনু কিন্তু মোক কার্ড না দিয়ে কইছে, এই টাকায় হয় নাই। তোক ২০ কেজি চাউলে নাম দেইম, তিন মাস পর পাবু।
এলাকার প্রভাবশালী মঞ্জু মিয়া কার্ড পেয়েছেন অভিযোগ ওঠে। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি মোটামুটি টাকা পয়সা ও জমির মালিক। তিনি স্বচ্ছল স্বীকার করে জানান, ৩০০ টাকা দিয়ে কার্ড নিয়ে অন্য একজনকে দিয়েছেন।
শুধু মঞ্জু মিয়া নয়, এরকম অনেক প্রভাবশালী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য কৃষকের নাম উঠেছে ১০ টাকার চালের তালিকায়।
এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. মজিদ বলেন, আমি আর কি বলব বাবা। কিছু অসাধু পুরুষ ও মহিলা ইউপি সদস্য, নামধারী গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং দলের লোকজন বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ৫০০-১০০০ করে টাকা নিয়ে কার্ড বিক্রি করেছেন। এতে প্রকৃত হতদরিদ্ররা এই কর্মসূচি থেকে বাদ পড়েছেন।
কিছু অনিয়মের কথা স্বীকার করে থানাহাট ইউনিয়নের তদারকি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকা, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, কিছু প্রভাবশালীদের নাম বা স্বামী স্ত্রীর দুজনার নামও এসছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি তা ঠিক করার।
চিলমারী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের আট হাজার ২১ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। প্রতি কেজি চাল গুদাম থেকে সাড়ে ৮ টাকায় ক্রয় করে কার্ডধারীদের মধ্যে ১০ টাকায় বিক্রির জন্য ১৭ জন ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তবে বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা দাবি করেন, স্বচ্ছভাবেই তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।
চিলমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা কিছু অনিয়মের কথা শুনেছি। তবে অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শুধু চিলমারী উপজেলায় নয়, উলিপুর, ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ীসহ প্রায় সব উপজেলাতেও একই অবস্থা।
আর রাজারহাট উপজেলায় দেখা দিয়েছে আরেক সমস্যা।কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফেলতির কারণে এখনো চাল বিতরণ শুরুই হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরান চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের দেওয়া তালিকা বাস্তবায়ন না করতে বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদস্যরা খাদ্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এতে করে এখনো চাল বিতরণ শুরু হয়নি।
এ ছাড়া ডিলার নিয়োগে দলীয় লোকজনকে বাদ দেওয়ায় নেতা-কর্মীরা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিছিলসহ তাকে লাঞ্ছিত করেছে বলেও জানা যায়।
এ ব্যাপারে রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম জানান, এ বিষয়টি উপজেলা খাদ্যকর্মকর্তা ভালো জানেন। চাল উত্তলন করা হয়েছে কিন্তু বিতরণ করা হয়নি। দ্রুত বিতরণ করা হবে।
উল্লেখ্য, ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ-ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে যারা হতদরিদ্র তাদেরকে ১০টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি চাল দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। বছরে পাঁচ বার এই চাল বিতরণ করা হবে।