জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে গত ১২ এপ্রিল ১১টি উপকমিটি গঠন করে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের জন্য আলাদা দুটি উপকমিটি রয়েছে। এই দুই কমিটি ইতিমধ্যে খসড়া গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র তৈরি করেছে। এই খসড়া থেকেই উল্লিখিত পরিবর্তনের তথ্য জানা গেছে।
ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগের জন্মের পটভূমি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলটির অবদান, আন্দোলন-সংগ্রাম, অর্জন, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মূলনীতি ও দলীয় দর্শন তুলে ধরা হয়। ঘোষণাপত্রটিই মূলত পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার হিসেবে মনে করছেন দলটির নেতারা। এ জন্য দলের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছানোর কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণাপত্র উপকমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম কমিটির বৈঠক শেষে ১৩ অক্টোবর গণমাধ্যমকে বলেছেন, এবারের ঘোষণাপত্রের আলোকেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরি হবে।
আর গঠনতন্ত্র হচ্ছে দলের সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মকাণ্ডের লিখিত দলিল। সর্বশেষ ২০০৯ ও ২০১২ সালের দুটি জাতীয় সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আকার বৃদ্ধির আলোচনা হয়েছিল। এবার তা বাস্তবায়নে শীর্ষ নেতৃত্ব সম্মত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। গঠনতন্ত্রে সংযোজনের জন্য অন্য যেসব প্রস্তাব এসেছে, সেগুলোর বেশির ভাগই প্রয়োজন মনে করে এর আগে বিভিন্ন সময়ে কার্যকর করা হয়েছে, এখন তা আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হচ্ছে।
দলীয় সভাপতি সম্পদ: আওয়ামী লীগের খসড়া ঘোষণাপত্রে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে দলের ‘প্রধান সম্পদ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘সমসাময়িক রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের শক্তি ও সম্পদ দুটোই। তাঁর দৃঢ় মনোবল, সাহসী নেতৃত্ব, তাৎক্ষণিক, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে দেশ ও বিদেশে তুমুল জনপ্রিয় করে তুলেছে। তিনি এখন তৃতীয় বিশ্বের অনন্য কণ্ঠস্বর।’ ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রীয় নানা অর্জনের পেছনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূমিকা, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পাওয়া সম্মাননার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
ঘোষণা উপকমিটির সদস্য ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাইদুর রহমান খান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এখন যেভাবে কাজ করছেন, তাতে তিনি শুধু দলের সম্পদ নন, তিনি এখন দেশের সম্পদ। এ জন্য ঘোষণাপত্রে এ ধারাটি যুক্ত করা হয়েছে।’
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান: এবারের ঘোষণাপত্রে ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান’ নিয়ে নতুন একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্জিত উন্নয়নের পথে এখন সবচেয়ে বড় বাধা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। এসবের পেছনে ‘বিএনপি-জামায়াত চক্র’ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে গণতন্ত্রের নামে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূলনীতি অংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব ধরনের উগ্রবাদ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান (জিরো টলারেন্স) গ্রহণ করবে। এবং আধুনিক পরমতসহিষ্ণু বহুদলীয় উদার গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গঠনে বদ্ধপরিকর থাকবে।
গণতন্ত্র, সংসদ ও জনপ্রশাসন: সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে খসড়া ঘোষণাপত্রে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ ও কার্যকারিতা ক্রমাগত বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত ও পরীক্ষিত নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলাই হবে আওয়ামী লীগের ব্রত। নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনপদ্ধতির চলমান-সংক্রান্ত প্রক্রিয়া আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে।
সংসদকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কতিপয় বিষয় ছাড়া সাংসদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হবে। জাতীয় সংসদই হবে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। সংসদে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। সংসদে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচ্যসূচিতে করে আলোচনা বাধ্যতামূলক করা হবে।
গঠনতন্ত্রের সম্ভাব্য পরিবর্তন: গঠনতন্ত্র অনুসারে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ৭৩ জন। এবার ৮টি পদ যুক্ত করে ৮১-তে উন্নীত করার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। এ ক্ষেত্রে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যসংখ্যা ৪টি বেড়ে হবে ১৯টি। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ তিনটি থেকে বেড়ে চারটি হবে। এ ছাড়া একটি সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের দুটি পদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে গঠনতন্ত্র-সংক্রান্ত উপকমিটি। দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাও ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন।
গত পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিষয়টি দলের গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। তাই দল মনোনীত প্রার্থী বাছাইয়ে ‘স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড’ গঠনের একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গঠনতন্ত্র উপকমিটির আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য হবেন ১৯ জন। দলের সভাপতি এই বোর্ডের সভাপতি হবেন এবং সদস্যসচিব হবেন দলের সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত পরিবারের কোনো সদস্যকে আওয়ামী লীগের সদস্য না করার বিধানও গঠনতন্ত্রে যুক্ত করা হয়েছে।
গঠনতন্ত্র উপকমিটির সদস্যসচিব আফজাল হোসেন বলেন, সময়ের প্রয়োজনে গণতন্ত্রের কিছু পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নতি হওয়ায় দলের সব স্তরের নেতাদের জন্য নির্ধারিত দলীয় চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়টিও যোগ করা হয়েছে।