বিশেষ প্রতিনিধি : ট্রান্সপ্যারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সম্প্রতি সংসদকে অবজ্ঞা ও করে প্রদত্ত রিপোর্ট নিয়ে সোমবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল জাতীয় সংসদ অধিবেশন। সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে অবিলম্বে টিআইবিকে সংসদের বিশেষ অধিকার ক্ষুন্ন সম্পর্কিত প্রিভিলেজ কমিটিতে তলব করে জবাবদিহী করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
টিআইবি সংসদকে পুতুল নাচের নাট্যশালা’- এমন উক্তি করে সংবিধান লংঘনের পাশাপাশি রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ করেছে উল্লেখ করে তাঁরা বলেছেন, টিআইবি বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের ভূমিকায় অবতীর্ণ। অবিলম্বে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন টিআইবি যদি ওই রিপোর্টের জন্য জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা না চায়, তবে জাতীয় সংসদে নতুন আইনের মাধ্যমে সংস্থাটিকে সাসপেন্ড এবং এনজিও’র তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এই ক্ষমতা সার্বভৌম জাতীয় সংসদের রয়েছে। একইসঙ্গে অভীন্ন সুরে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা টিআইবির অর্থের উৎস্য খুঁজে বের করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মাগরিবের নামাজের বিরতীর পর এই অনির্ধারিত বিতর্কের সূত্রপাত করেন বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ। তাঁকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজি ও জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ।
বিতর্কের সূত্রপাত করে বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ টিআইবি’র রিপোর্টের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, সংস্থাটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদকে পুতুলের নাট্যশালা বলে মন্তব্য করেছে। বিরোধী দলকে কথিত বিরোধী দল হিসেবে উল্লেখ করেছে। এমন রিপোর্টের মাধ্যমে তারা দেশের জনগণকেই অপমানিত করেছে। তাই টিআইবির স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা দরকার।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, টিআইবি যে মন্তব্য করেছে তা তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত। শেখ হাসিনা যখন আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কার পাচ্ছেন, সারাবিশ্বে বাংলাদেশ প্রশংসিত হচ্ছে- তখনই দু’জন বিদেশীকে হত্যা করা হয়। এ নিয়ে তখন কিছু কিছু দূতাবাস অতিরিক্ত রিএ্যাকশন দেখিয়েছে। আমরা ওইসব দেশের কিছু কূটনীতিকদের বলেছি, এই অতিরিক্ত রিএ্যাকশন পক্ষান্তরে হত্যাকারী, জঙ্গী ও সন্ত্রাসীরা উৎসাহিত করবে। এরপরই রংপুরে জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। দেশের এ অবস্থায় টিআইবি হঠাৎ করেই এমন বিভ্রান্তমূলক রিপোর্ট দিয়েছে।
তিনি বলেন, টিআইবি প্রমাণ করেছে বিএনপির একটি অঙ্গ সংগঠন। কারণ খালেদা জিয়া সংলাপ ও নির্বাচন চান, একই সুরে টিআইবি কথা বলেছে। বিএনপি-জামায়াত দুই বিদেশীকে হত্যা করে বাংলদেশকে নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিতে চায়। তাই অনতিবিলম্বে টিআইবিকে অবিলম্বে প্রিভিলেজ কমিটিতে হাজির করে প্রশ্নের সন্মুখীন করতে হবে, কীভাবে তারা টাকা পায়, কে অর্থায়ন করে। এ সবের জবাব নিতে হবে।
প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, টিআইবি আইন, সংবিধান, সংসদ ও সরকারের উর্ধ্বে। সংসদ ও রাষ্ট্র কী এতোই অসহায় টিআইবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। টিআইবি অবশ্যই দায়বদ্ধ সংস্থা, আইন, সংবিধান ও সংসদের অধীন। এর এক চুলও বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, সংবিধান কোন কাগজ নয়, আর সংসদ না থাকলে জনগণ রিপাবলিক থাকে না। সার্বভৌম সংসদকে পুতুল নাচের নাট্যশালা বলে টিআইবি সংবিধান লংঘনের পাশাপাশি চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তিনি বলেন, টিআইবি সংসদকে কটাক্ষ করে রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ করেছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে অবনতমস্তকে টিআইবিকে ক্ষমা চেয়ে বলতে হবে আগামীতে সংবিধান লংঘন করবে না, অন্যথায় টিআইবি অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। জাতীয় সংসদ যদি টিআইবিকে সাসপেন্ড করে দেয়, সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীরও কিছু করার থাকবে না। সেই ক্ষমতা সার্বভৌম জাতীয় সংসদের রয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, টিআইবির সুতোর টান কোথায়? একটি চিহ্নিত শক্তির সুতোর টানে নাচছে তারা। ধৃষ্ঠতার সীমাও লংঘন করেছে সংস্থাটি। দেশের মানুষ পাঁচ বছরের জন্য এই সংসদকে রায় দিয়েছে। তাই পাঁচ বছর পরই নির্বাচন হবে, কোন অবৈধ পথ পানে চেয়ে থেকে লাভ হবে না। তিনি বলেন, যখন দু’জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় শেষ পর্যায়ে, তখনও অত্যন্ত বিচলিত হয়েছে সংস্থাটি আবোলতাবোল বকছে।
জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র ভারতের থেকেও শক্তিশালী। কিছু জানোয়ারা কিছু ঘটনা ঘটাবেই, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার সম্পন্ন করলে এসব অপকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। টিআইবি আমাদের সংবিধান, সংসদকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে।
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডে আওয়ামীপন্থীরাই বেশী রয়েছে। এ দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারলে, কার লাভ হবে? এটি জনগণ জানে। তবে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা কেন নেওয়া হচ্ছে না? হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে, দেশে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারছি না। এদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
সরকারি দলের সাবেক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, যে সময় বর্তমান সরকারের আমলে দেশ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ পুরস্কৃত হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, দেশের মানুষ শান্তিতে আছে- ঠিক তখনই এমন বিতর্কিত রিপোর্ট দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত এবং দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে টিআইবি। তাই সংস্থাটির অর্থের উৎস্য, কারা অর্থায়ন করছে তা খুঁজে বের করার পাশাপাশি টিআইবির কার্যক্রম কী হবে – তা সুনির্দিষ্ট করা উচিত।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, সংসদকে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অবমাননা করে তবে স্পীকারের নেতৃত্বে গঠিত প্রিভিলেজ কমিটিতে তাকে হাজির করার বিধান রয়েছে। ১৫ কোটি মানুষের প্রাণের কেন্দ্র জাতীয় সংসদ সদস্য। কমিটিতে টিআইবিকে তলব করে জবাবদিহীতা আদায় করতে হবে।