খুলনার কেশবপুরের বাসিন্দা মতিয়ার রহমান ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন রুটে বাস ও ট্রাক চালান। ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেসার, চোখের পাওয়ার ঠিক আছে কিনা তা কখনো পরীক্ষা করাননি। শরীরে কোনো জটিলতা আছে কিনা তাও জানা নেই তার। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নে তিনি কোনো বাধার মুখে কখনোই পড়েননি। মতিয়ার রহমান নিজেই স্বীকার করেন, লাইসেন্স নবায়নের জন্য কখনো মেডিকেল টেস্ট করা লাগেনি তার। দালাল ধরে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে লাইসেন্স নবায়ন করেন। মতিয়ারের মতোই অবস্থা ঢাকা-খুলনা রুটে চলাচলকারী রাজীব পরিবহণের চালক মো. নাসিরের। তিনিও কখনো চোখ বা শরীরে জটিলতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করাননি। অথচ নিয়মিত গাড়ি চালাচ্ছেন, নবায়ন করছেন লাইসেন্সও।
শুধু মতিয়ার বা নাসিরই নন। তাদের মতো দেশের বিভিন্ন গণপরিবহণ ও ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের বেশির ভাগই নানা রোগেশোকে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ৭৩ ভাগই চোখে দৃষ্টিশক্তিজনিত সমস্যায় ভুগছেন। অন্যদিকে ৬০ ভাগেরও বেশি চালক গাড়ি চালানোর জন্য শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ নন। তাদের কেউ উচ্চ রক্তচাপ, কেউ উচ্চ ব্লাড সুগারে ভুগছেন। চোখের সমস্যাসহ নানা ধরনের অসুস্থতা নিয়েই চালকদের এই অংশটি গাড়ি চালায়। এতে করে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানী ঢাকাসহ জেলা পর্যায়ে ৮২৪ জন চালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এমন তথ্য পায় বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। এসব চালকের দ্রুত চোখ ও শারীরিক অন্যান্য সমস্যার চিকিৎসা প্রয়োজন বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। বিনামূল্যে চালকদের চোখের চিকিৎসার কথা বলেছেন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য একদিকে যেমন অদক্ষ চালক দায়ী, তেমনি চালকদের অসুস্থতাও একটা বড় কারণ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৬ হাজার ৯১১টি দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫২৪ জন নিহত এবং ১১ হাজার ৪০৭ জন আহত হয়েছেন। চালকের অসুস্থতার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। পরিবহণ মালিকদেরও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। উলটো তারা বলছেন, স্বাস্থ্যগত এসব ত্রুটি ধরতে গেলে দেশে চালক সংকট তৈরি হবে। তাই চালকদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে কোনো খোঁজ রাখেন না তারা।
আইনে চালকদের এমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়া ও নবায়নের সুযোগ নেই। লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। একাধিক গাড়ির চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কোনো ধরনের শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াই দালালের মাধ্যমে লাইসেন্স নবায়ন করে নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার সময় মেডিকেল টেস্ট করে থাকি। শরীর সুস্থ থাকার মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট জমা নিয়ে লাইসেন্স দিই। ডোপ টেস্ট ছাড়া এখন চালকদের লাইসেন্স দেওয়া হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পেশাদার চালকদের পাঁচ বছর পরপর এবং অপেশাদার চালকদের দশ বছর পরপর লাইসেন্স নবায়নের সময় মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে থাকি। কারও রিপোর্ট নেগেটিভ হলে তার লাইসেন্স নবায়ন করি না।’
অসুস্থ শরীরে কীভাবে লাইসেন্স পাচ্ছেন ওইসব চালক এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন এ কর্মকর্তা।
সম্প্রতি আহ্ছানিয়া মিশনের উদ্যোগে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২৩ এবং ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেম্বারেন্স ফর রোড ট্রাফিক ভিক্টিমস-২০২৩ উদযাপন উপলক্ষ্যে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষ্যে রাজধানীর নিকুঞ্জ এবং উত্তরা বিআরটিএ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গাবতলী বাস টার্মিনাল, মহাখালী বাস টার্মিনাল, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল এবং কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে স্বাস্থ্য ক্যাম্প পরিচালিত হয়।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন সূত্র বলছে, ওইসব ক্যাম্পে ৮২৪ জন চালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৪১ জন চালক চক্ষু পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৫৪১ জন চালকের প্রায় ৭৩ ভাগেরই দৃষ্টিশক্তিজনিত সমস্যা পাওয়া গেছে। তাদের চশমা ব্যবহার করা প্রয়োজন। এছাড়া ৪ ভাগ চালকের চোখে ছানি সমস্যা এবং ২৩ ভাগ অন্যান্য চোখের সমস্যা যেমন- শুষ্ক চোখ, অ্যালার্জির সমস্যা ইত্যাদি পাওয়া যায়। ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত ২৬ ভাগ এবং ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত ২৩ ভাগ চালকের চোখের সমস্যা পাওয়া গেছে।
৮২৪ জন চালকের মধ্যে ৪০০ জন চালকের ব্লাড সুগার হাই যা শতকরা হিসাবে ৪৯ ভাগ। উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন ৩১ ভাগ চালক। এছাড়া উচ্চ ব্লাড সুগার এবং উচ্চ রক্তচাপ উভয় সমস্যায়ই ভুগছেন ১৭ ভাগ চালক। ৬০ ভাগের বেশি চালক গাড়ি চালানোর জন্য শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ নন।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের রোড সেফটি প্রকল্পের সমন্বয়কারী শারমিন রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ক্যাম্পেইনে সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ব্লাড প্রেসারের মাত্রা, সুগারের মাত্রা, উচ্চতা অনুযায়ী ওজন এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত ছিল। একইভাবে চোখের পরীক্ষায় দৃষ্টিশক্তির কাছাকাছি এবং দূরবর্তী সীমা, চালকদের ছানি পরীক্ষা এবং সেই অনুযায়ী পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের এ প্রতিবেদন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘চালকদের রোগ থাকতেই পারে। লাইসেন্স দেওয়ার সময় ও নবায়ন করার সময় কর্তৃপক্ষের এগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার। তিনি আরও বলেন, এমনিতেই দেশে সাত থেকে আট লাখ গাড়িচালকের ঘাটতি রয়েছে।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, আমি অনুরোধ করব বিআরটিএ যেন চোখে সমস্যাগ্রস্ত চালকদের গাড়ি চালানোর অনুমতি না দেয়। যেসব চালকের চোখে সমস্যা আছে তারা যদি আমাদের হাসপাতালে আসেন, বিনা পয়সায় তাদের চোখের পরীক্ষা করব।