আশরাফুল আলম,সোনারগাঁ(নারায়ণগঞ্জ) থেকে ঃ আবহমান বাংলার লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ লোক কারুশিল্পের তীর্থ ভূমি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে গত ১৪ই জানুয়ারী থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী চলবে কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব। রূপসী বাংলার জল-মাটি-হাওয়ার অনুবর্তী হয়ে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে বাংলা ও বাঙালীর ঐতিহ্যে মন্ডিত লোক ও কারুশিল্প মেলা। মন চলো রূপের নগরে। বাংলার রং-রূপের পসরা নিয়ে ঈশা খাঁর বীরত্বে গর্বিত বহ্ম্রপুত্র, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা নদী বিধৌত, ছায়া ঘেরা, পাখি ডাকা, কোকিলের কুহুতানে বিভোর ফাল্গুণের রংঙিলা হাওয়া, জুই, চামেলী আর কৃষ্ণচুড়ার মিষ্টি আমেজে প্রাণ শিহরিয়ে আপন খেয়ালে নজরুলের সুরে শিল্পী গেয়ে ওঠে, “একি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লী জননী”। বাংলার সেই শাশ্বত রূপ নিয়ে, লাল, নীল, হলুদ আর সবুজের ছড়াছড়িতে মাসব্যাপী চলছে সোনারগাঁ লোক কারুশিল্প মেলা ফাউন্ডেশনের বিশাল চত্বর জুড়ে। মসলিনের মসৃনতায় আর জামদানির কারু কাজের নিপুনতায় গরবিনি, আবহমান কাল ধরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কারুশিল্পীর সাথে নিপুন হাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে, অনুভব ও চেতনার ব্যঞ্জনাকে মূর্ত করে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ একে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া লোক সংস্কৃতি লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন সমূহের সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রদর্শন ও পূনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতি বছর মাসব্যাপী মেলা ও লোকজ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কারুশিল্পীদের তৈরি পন্য প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য মেলায় ১৭২ টি স্টল স্থান পেয়েছে। মেলায় এলে ফাউন্ডেশনের প্রধান ফটক পার হলেই প্রথমেই দর্শনার্থীদের নজরে পড়বে ঈশা খাঁর রক্ষী ফৌজের দুই বীর অস্ত্র হাতে ঘোড়ার পিঠে আসীন। সৈন্যদের দৃঢ় প্রত্যয় দৃষ্টি যেকোন দর্শনার্থীকে স্বরণ করিয়ে দিবে ঈশা খাঁর বীরত্ব খচিত জীবন কাহিনী। অন্যান্য বছরের মত এবারও মেলার আয়োজনে রয়েছে প্রতিদিন জারিগান, পালাগান, বাউল গান,শরিয়তী- মারফতি গান,আলকাপ গান, কবিগান,লালন সংগীত,মাইজভান্ডারী গান, হাসন রাজার গান, ভাটিয়ালী গান, ভাওয়াইয়া গান, লোকজ নৃত্য, পিঠা উৎসব গ্রামীন খেলা, লাঠিখেলা,ঘুড়ি ওড়ানো,লোকজ কবিতা ও ছড়া পাঠের আসর,পুঁথি পাঠ,ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,গাঁয়ে হলুদের গান, লোকজ গল্প বলা ইত্যাদি। সব মিলে যেন এক জীবন্ত প্রদর্শনী। মেলায় দেশের বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীন জীবন ধারার আলোতে খেলাধুলা প্রদর্শন ও সেমিনার উপস্থাপিত হচ্ছে। এই মেলায় নওগাঁ ও মাগুরার শোলা শিল্প, রাজশাহীর শঁখের হাঁড়ি, চট্টগ্রামের তালপাতার হাতপাখা, রংপুরের শতরঞ্জি, সোনারগাঁয়ের হাতি ঘোড়া পুতুল ও কাঁঠের পুতুল, কারুশিল্প ও নকশী কাথা, মুন্সীগঞ্জের শীতল পাটি, কুমিল্লার তামা-কাসা ও পিতলের কারুশিল্প, রাঙ্গামাটির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কারুপন্য ও কিশোরগঞ্জর টেরাকোটাশিল্প সহ ৪৮ জন কারুশিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য পসরা সাজানো হয়েছে। এই মেলার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গ্রাম বাংলার লোকজ তৈজসপত্র, পন্য সামগ্রী, প্রাকৃতজনের আচার আচরণের সাথে সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন এবং পিতামহ-মাতামহীদের যুগের খাদ্য সামগ্রী যেমন বাতাসা, কদমা, খই উখড়া, মিষ্টি, জিলেপী, সন্দেশ, ইত্যাদি আধুনিক প্রজন্মের লোকদের সামনে উপস্থাপন করা।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে আয়োজিত মাসব্যাপী উৎসব যেনো বাংলাদেশের দীর্ঘতম গবেষণাধর্মী মেলার একটি সংযোজন। উৎসবের আয়োজনে যুক্ত হয়েছে অনাবিল আনন্দের অমিয়ধারা, বাংলার শ্যামল প্রান্তরের নিভৃত গৃহকোণে তৈরি নিপুন হাতের কোমল কুশলী স্পর্শে প্রতিভাবিত উৎকর্ষের বৈচিত্র্যময় প্রকাশ ও তার বাণিজ্যিক দিগন্ত উন্মোচনের অপূর্ব সুযোগ বয়ে আনবে এই মেলার মাধ্যমে। এই অনুপম সৃষ্টির ধারাকে অব্যাহত রাখতে, এতে উৎকর্ষ আনতে তাদের ক্লান্তিহীন উদ্যম, নিরন্তর প্রগতির সাথে ঐতিহ্যকে যুক্ত করে সংস্কৃতির ধারাকে অক্ষুন্ন রাখার কাজে নিয়োজিত রয়েছে নাম না জানা অনেক বরেণ্য শিল্পী।