Sunday , 19 May 2024
নিউজ টপ লাইন

দিনে অলিগলি, রাত হলেই বেপরোয়া রাজপথে

ঢাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বছরের পর বছর চলছে এসব অবৈধ যানবাহন। এদের লাগাম টানতে পারছেন না কেউ। বরং দিনদিন এ পরিবহণের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া চলাচলের কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

দিনে ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে চলাচল করে ব্যাটারিচালিত রিকশা। আর রাত ৯টার পর এ রিকশা নিয়ে মূল সড়কে চলে আসেন চালকরা। ভোর পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ান বিভিন্ন এলাকা। ফলে রাতের ঢাকায় রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেও ভয়ে থাকেন সাধারণ মানুষ।

একাধিক চালক জানিয়েছেন, রাতে প্রধান সড়কগুলোয় গণপরিবহণ কম থাকে। মানুষ বিভিন্ন জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকেন পরিবহণের জন্য। আর এ সুযোগটাই বেছে নেন তারা। তাছাড়া রাতের সড়ক অনেকটা যানজটমুক্ত থাকে, পাশাপাশি তখন পুলিশের নজরদারিও কম থাকে। তবে পুলিশ বলছে, ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। যেসব ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে, তা তাদের চোখ ফাঁকি দিয়েই চলছে।

ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, অপরাধীদের গ্রেফতার করলে যেমন তারা জামিনে বের হয়ে এসে পুনরায় একই অপরাধে জড়ায়, ঠিক তেমনই ব্যাটারিচালিত রিকশাচালককে জরিমানা করা হলেও তারা আবারও রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামছে। তিনি বলেন, যেসব গ্যারেজে রিকশা রাখা হয়, চার্জ দেওয়া হয়, সেসব গ্যারেজ মালিকদের আগে আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হলে এসব রিকশার দাপট কিছুটা কমানো যেত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর, কাফরুল, দারুসসালাম, পল্লবী, উত্তরা, উত্তরখান, তুরাগ, দক্ষিণখান, খিলগাঁও, রামপুরা, সবুজবাগ, বাড্ডা, লালবাগ, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, আদাবর, শ্যামপুর, জুরাইন, কদমতলী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। এসব পরিবহণ দিনে অলিগলিতে যানজটের সৃষ্টি করে। আর রাতে যখন মূল সড়কে উঠে আসে, তখন বাড়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

রোববার রাতে মিরপুর-১ নম্বরে কথা হয় রিকশাচালক আলী হোসেনের সঙ্গে। রূপনগরের একটি বস্তিতে থাকেন তিনি। আলী হোসেন বলেন, রাতে মূল সড়কে যাত্রী বেশি পাওয়া যায়, পুলিশও ধরতে আসে না, এসব কারণে রাতভর রিকশা চালাই। আর দিনে সুযোগ পেলে অলিগলিতে চালিয়ে কিছুটা আয় করি। তাছাড়া রাতে রাস্তা ফাঁকা থাকে, দূরের ট্রিপও পাওয়া যায়। স্বল্প শ্রমে আয় বেশি করা যায়।

জানা যায়, ২০১৪ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে ২০১৭ সালে আরেক দফা বন্ধের নির্দেশনা আসে। এরপর ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ ও আমদানি নিষিদ্ধ করে আবারও নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। এরপরও দিনদিন বাড়ছে এ রিকশার দৌরাত্ম্য।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়, এর ২০ শতাংশই ব্যাটারিচালিত রিকশায়। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত দুরূহ। সেই সঙ্গে জীবিকার বিষয়টিও ভাবতে হবে। চাইলে কাঠামোর মান উন্নয়ন করে এগুলো সড়কে চলাচলের উপযোগী করা সম্ভব।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশা। ঝুঁকিপূর্ণ এ যানবাহনটি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, অনুমোদিত যানবাহন রাজধানীতে চলাচল করছে। সুষ্ঠুভাবে এসব পরিবহণ পরিচালনা না করার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা আলোচনা করা যায়। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশার তো কোনো বৈধতা নেই। এটা কীভাবে রাজধানীতে চলাচল করছে। এটা যাদের দেখার দরকার, তাদেরকে সুষ্ঠুভাবে এ কাজগুলো করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর অলিগলিতে টোকেনে চলে ব্যাটারিচালিত রিকশা। টোকেন না থাকলে পুলিশ ধরে ডাম্পিংয়ে দিয়ে দেয়। তাছাড়া এসব অবৈধ যান বন্ধ না হওয়ার পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা, পুলিশ ও চাঁদাবাজরা জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে।

একাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক জানিয়েছেন, তারা মাসোহারা দিয়ে টোকেন নিয়েই সড়কে চালান। প্রতি মাসে টোকেন খরচ ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা নেওয়া হয়। চালকরা জানিয়েছেন, যেসব গ্যারেজে তারা ব্যাটারিচালিত রিকশা রাখেন, সেসব গ্যারেজ থেকেই টোকেন সংগ্রহ করেন। গ্যারেজ মালিকদের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা সিন্ডিকেটের যোগাযোগ রয়েছে।

বিনিময়ে গাছ, ফুল, তারা, পাখিসহ বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে টোকেন ধরিয়ে দেওয়া হয়। টোকেন থাকলে এসব রিকশা পুলিশ ধরে না। আর টোকেন না থাকলেই ধরে নিয়ে যায়। একেকটি রিকশা ছাড়াতে জরিমানা গুনতে হয় ২৬০০ থেকে তিন হাজার টাকা। ব্যাটারিচালিত রিকশাকে কেন্দ্র করে চক্রগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে বছরে কোটি কোটি টাকা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার ফারুক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এসব রিকশা অলিগলিতে চললেও মূল সড়কে উঠলেই ডাম্পিং করা হয়। রাতে রিকশা চলার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে। তাছাড়া অবৈধ গ্যারেজ মালিকদের বিরুদ্ধে ডিএমপি আগে থেকেই অভিযান চালায়। উপকমিশনার বলেন, কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিই।

About admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top