Friday , 3 May 2024
নিউজ টপ লাইন
৩৬৫ দিনই পাশে

৩৬৫ দিনই পাশে

চলতি বছরের ৭ ডিসেম্বর। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া যৌনপল্লী থেকে জাতীয় জরুরি সেবা সেন্টারের ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করেন এক ব্যক্তি। তিনি জানান, বিউটি পার্লারে চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে চার কিশোরীকে যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। চার মাস আগে শুভ নামে এক দালালের কাছ থেকে তাদের কিনেছেন রূপা বেগম। যিনি দীর্ঘদিন ধরে দৌলতদিয়ায় বিভিন্ন বয়সী নারীদের যৌন ব্যবসায় লিপ্ত হতে বাধ্য করে আসছেন। যৌনপল্লীতে খদ্দের হিসেবে আসা ওই ব্যক্তি ওই চার কিশোরীর জীবনের করুণ কাহিনী জানতে পারেন। তারা যৌনপল্লী থেকে মুক্তির জন্য তার সহায়তা চায়। এতে মন গলে যায় তার। ওই রাতেই তিনি ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে চার কিশোরীকে উদ্ধারের আকুতি জানান।

জাতীয় জরুরি সেবাকেন্দ্র থেকে তখনই যোগাযোগ করা হয় গোয়ালন্দ ঘাট থানায়। ভোর রাতে যৌনপল্লীতে অভিযান চালিয়ে চার কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় রূপা বেগমকে। জীবনের কঠিন অধ্যায় থেকে মুক্তি মেলে তাদের। শুধু গোয়ালন্দ যৌনপল্লী থেকে চার কিশোরী উদ্ধারের ঘটনা নয়, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ প্রতিনিয়ত সেবাপ্রত্যাশী অসহায় মানুষের মুক্তির দূত হিসেবে হাজির হচ্ছে। বিরতিহীনভাবে ৩৬৫ দিন মানুষের পাশে থাকে ৯৯৯। সহায়তার ডাক শুনতে তারা ভালোবাসে। বন্ধুত্বের হাত নিয়ে নির্ঘুম বসে থাকে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দেয় সহমর্মিতার বার্তা। গত এক বছরে ৯৯৯ হয়ে উঠেছে নির্ভরতার প্রতীক।

আজ বুধবার জাতীয় জরুরি সেবার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের পরিচালিত একটি পাইলট প্রকল্প ছিল। পরীক্ষামূলকভাবে নাগরিকদের জরুরি প্রয়োজনে সম্পূর্ণ টোল ফ্রি পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়া হতো। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বেসরকারি মেডিকেল ইমার্জেন্সি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান প্লাস- ওয়ানের সেবার সমন্বয় ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এর কার্যক্রম ২০১৬ সাল থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে চালু হয়। তখন হাইটেক পার্কের প্রশাসনিক ভবনের দোতলায় আধুনিক কল সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে ৯৯৯-এর কর্মসূচির সূচনা হয়। পাইলট কর্মসূচির গবেষণায় দেখা যায়- জরুরি সেবা প্রার্থীদের ৬৮ শতাংশ পুলিশি সেবা, ৩০ শতাংশ ফায়ার সার্ভিস ও ২ শতাংশ অ্যাম্বুলেন্স সেবা চেয়েছেন।

পাইলট কর্মসূচি শেষে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশনা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ পরিচালনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে পুলিশ আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি ও কারিগরি সরঞ্জামাদি সংযোজন করে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের পঞ্চম তলায় ৩০টি লাইনে ১০০ জন জনবলের মাধ্যমে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস সেন্টারের কার্যক্রম শুরু করে। সেন্টারটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। পরে এই কল সেন্টার সম্প্রসারণ করে ডিএমপি কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের ষষ্ঠ তলায় স্থাপন করা হয়। এখানে বর্তমানে ১০০টি লাইনে ৪৬৮ জনবলের মাধ্যমে জরুরি সেবা দেওয়া হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে শুধু টিঅ্যান্ডটি অথবা মোবাইল ফোন চ্যানেল থেকে ৯৯৯-এ ডায়াল করে জনগণ জরুরি সেবা নিতে পারতেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে সেবাটিতে মাল্টিপল চ্যানেল যুক্ত করার মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া ইন্টিগ্রেশন ও এসওএস অ্যাপ্লিকেশনের ফিচার যুক্ত করা হয়। বর্তমানে দেশের যে কোনো নাগরিক ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করার মাধ্যমে বা এসওএস অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করার মাধ্যমে মাল্টিপল চ্যানেলে জরুরি সেবা নিতে পারবেন।

জাতীয় জরুরি সেবা কেন্দ্রের গত এক বছরের কার্যক্রম বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ৯৯৯-এ মোট কল এসেছে ১২ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৫টি। এর মধ্যে ৪৪ হাজার ৪৯০টি কলে ঘটনাস্থলে গিয়ে সেবা দেওয়া হয়েছে, যা জরুরি কল হিসেবে বিবেচিত। মোট কলের মধ্যে ইনকোয়ারি কল হলো ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭৩টি। যেসব কল থেকে সেবাপ্রত্যাশীরা কোনো বিষয়ে জানতে চেয়েছেন তা ইনকোয়ারি কল হিসেবে পরিচিত। গত এক বছরে ২৮ হাজার ৯৯৯ জন নারী বিভিন্ন ধরনের সেবা চেয়ে কল করেন। ১৮ বছরের নিচের নাগরিকের কাছ থেকে কল এসেছে এক লাখ তিন হাজার ২৪১টি, যা ‘চাইল্ড কল’ নামে পরিচিত। ডিপার্টমেন্টাল কল গিয়েছে ১০ হাজার ৬১২টি। মোট কলের মধ্যে পুলিশি সেবা-সংক্রান্ত কল ৩১ হাজার ৩৭টি। ফায়ার সার্ভিস-সংক্রান্ত কল আট হাজার ১৫৫টি, অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে কল রয়েছে দুই হাজার ১২৮টি। অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ কলই পুলিশি সেবা-সংক্রান্ত।

ইভেন্ট অনুযায়ী পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জাতীয় জরুরি সেবা থেকে গত এক বছরে দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত সেবা দেওয়া হয় চার হাজার ৫৯৬টি, মাদকদ্রব্যজনিত এক হাজার ৮৫০, জননিরাপত্তামূলক দুই হাজার ৮৬৯, খুনের চেষ্টা মোকাবেলায় ২৯৪, অপহরণ ৭৬১, ঘরোয়া সহিংসতা ৭৩১, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ এক হাজার ১৮৯, পারিবারিক সমস্যা ৬২৯, নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ প্রতিরোধ ৫৪২, গ্যাস লাইন লিকেজ-সংক্রান্ত ২০১, শব্দদূষণ প্রতিরোধ এক হাজার ১৯৮, প্রতারণা ৬৬২, জুয়া এক হাজার ৩৯, ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এক হাজার ৫৭২, মারামারি তিন হাজার ৪৭৪, সাইবার অপরাধ ২২৪, হিজড়া আক্রমণ ২৮৩, চুরি ৫৬৯, শিশুর প্রতি সহিংসতা ৬৬, বোমা-সংক্রান্ত তথ্য ৩০, নিখোঁজ ২৪৯, হুমকি ৭৯২, ব্যাগ ছিনতাই ১১১, ডাকাতি ৩৪১, রাশ ড্রাইভিং ৮১, ছিনিয়ে নেওয়া সংক্রান্ত ১০০, ছুরিকাঘাত ২৮, অর্থ পাচার ৩, মানব পাচার ৪ ও অগ্নি দুর্ঘটনা ৪ হাজার ৮৩৪টি। সেবাপ্রার্থীদের ৯২ শতাংশ পুরুষ এবং ৮ শতাংশ নারী। এ ছাড়াও বিভাগওয়ারি হিসাবে ঢাকা থেকে ৬৮ শতাংশ, চট্টগ্রাম থেকে ১০ শতাংশ, রংপুর আট, সিলেট থেকে দুই, ময়মনসিংহ থেকে এক, বরিশাল থেকে দুই, রাজশাহী থেকে চার শতাংশ কলার কল করেছেন। গতকাল সরেজমিন জাতীয় জরুরি সেবা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কর্মীরা ব্যস্ত নিজ নিজ ডেস্কে। কল এলেই সেবাপ্রত্যাশীর কথা শুনছেন তারা। এর পর নিচ্ছেন দ্রুত ব্যবস্থা।

এ ব্যাপারে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সমকালকে বলেন, ৯৯৯ পুলিশ ও জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। এতে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ উপকৃত হচ্ছে। জাতীয় জরুরি সেবার এ উদ্যোগ একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। শুধু পুলিশি সহায়তা নয়, নানা ধরনের সেবা চেয়ে সাধারণ মানুষ ফোন করছেন। ৯৯৯ নম্বর থেকে ফোন করা হলে পুলিশের যে কোনো ইউনিট অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে তা কার্যকর ভূমিকাও রাখছে। ধীরে ধীরে এই সেবার পরিধি বাড়ানো হবে।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর পুলিশ সুপার মো. তবারক উল্লাহ সমকালকে বলেন, সেবার মান আরও বিস্তৃত করার বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনো সেবাপ্রত্যাশী কল করলে তিনি কোন এলাকায় রয়েছেন এবং তার সবচেয়ে কাছাকাছি পুলিশের কোন টহল টিম রয়েছে তা কল সেন্টারে বসে মনিটরে দেখার প্রযুক্তি সংযোজিত হচ্ছে। প্যানাসনিক কোম্পানি থেকে পুলিশের জন্য বিশেষ ডিভাইস আনা হচ্ছে। প্রথমে মেট্রোপলিটন এলাকার পুলিশের টহল গাড়িতে ওই ডিভাইস লাগানো হবে।

About admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

Scroll To Top